কবি হুমায়ুন আজাদ কবিতা-সমূহ - TECHNICAL BANGLA

কবি হুমায়ুন আজাদ কবিতা-সমূহ

আসসালামু আলাইকুম, বন্ধুরা সবাই কেমন আছেন,,,??আশা করি সবাই ভালো আসেন। Technical Bangla পক্ষ থেকে আমি নয়ন আছি আপনাদের সাথে,,,,,বরারবে মতো আবারও আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।

হ্যালো বন্ধুরা কবিতা পর্ব-১৮: তে আপনাদের আবার স্বাগতম।সবাই মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।কবিতা গুলো আপনার ভালো লাগলে সবার মাঝে শেয়ার করুন।  আজকে আমি  নিয়ে এসেছি কবি  হুমায়ুন আজাদ  এর লেখা ১২ টি কবিতা।
চলুন দেখে আসি কবিতা গুলো-


১.  গরীবের সৌন্দর্য
      হুমায়ুন আজাদ

গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না।
গরিবদের কথা মনে হ’লে সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে না কখনো।
গরিবদের ঘরবাড়ি খুবই নোংরা, অনেকের আবার ঘরবাড়িই নেই।
গরিবদের কাপড়চোপড় খুবই নোংরা, অনেকের আবার কাপড়চোপড়ই নেই।
গরিবেরা যখন হাঁটে তখন তাদের খুব কিম্ভুত দেখায়।
যখন গরিবেরা মাটি কাটে ইট ভাঙে খড় ঘাঁটে গাড়ি ঠেলে পিচ ঢালে তখন তাদের
সারা দেহে ঘাম জবজব করে, তখন তাদের খুব নোংরা আর কুৎসিত দেখায়।
গরিবদের খাওয়ার ভঙ্গি শিম্পাঞ্জির ভঙ্গির চেয়েও খারাপ।
অশ্লীল হাঁ ক’রে পাঁচ আঙ্গুলে মুঠো ভ’রে সব কিছু গিলে ফেলে তারা।
থুতু ফেলার সময় গরিবেরা এমনভাবে মুখ বিকৃত করে
যেনো মুখে সাতদিন ধ’রে পচছিলো একটা নোংরা ইঁদুর।
গরিবদের ঘুমোনোর ভঙ্গি খুবই বিশ্রী।
গরিবেরা হাসতে গিয়ে হাসিটাকেই মাটি ক’রে ফেলে।
গান গাওয়ার সময়ও গরিবদের একটুও সুন্দর দেখায় না।
গরিবেরা চুমো খেতেই জানে না, এমনকি শিশুদের চুমো খাওয়ার সময়ও
থকথকে থুতুতে তারা নোংরা করে দেয় ঠোঁট নাক গাল।
গরিবদের আলিঙ্গন খুবই বেঢপ।
গরিবদের সঙ্গমও অত্যন্ত নোংরা, মনে হয় নোংরা মেঝের ওপর
সাংঘাতিকভাবে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে দু’টি উলঙ্গ অশ্লীল জন্তু।
গরিবদের চুলে উকুন আর জট ছাড়া কোনো সৌন্দর্য নেই।
গরিবদের বগলের তলে থকথকে ময়লা আর বিচ্ছিরি লোম সব জড়াজড়ি করে।
গরিবদের চোখের চাউনিতে কোনো সৌন্দর্য নেই,
চোখ ঢ্যাবঢ্যাব ক’রে তারা চারদিকে তাকায়।
মেয়েদের স্তন খুব বিখ্যাত, কিন্তু গরিব মেয়েদের স্তন শুকিয়ে শুকিয়ে
বুকের দু-পাশে দুটি ফোড়ার মতো দেখায়।
অর্থাৎ জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।
শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়।

২. আমাদের মা
  হুমায়ুন আজাদ

আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।
আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।

৩.  আমার অশ্রু
    হুমায়ুন আজাদ 

মূলঃ হেনরিক হাইনে
আমার অশ্রু এবং কষ্টরাশি থেকে
ফুটে উঠে ফুল থরে থরে অফুরান,
এবং আমার দীর্ঘশ্বাসে
বিকশিত হয় নাইটিংগেলের গান । 

বালিকা, আমাকে যদি তুমি ভালোবাসো,
তোমার জন্য সে ফুল আনবো আমি—
এবং এখানে তোমার দ্বারের কাছে
নাইটিংগেলেরা গান গাবে দিবাযামি ।


৪.   আমার কুঁড়েঘরে
         হুমায়ুন আজাদ

আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল 
তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে 
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে 
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আর দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে 
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক 

আমার গ্রহ জুড়ে বিশাল মরুভূমি 
সবুজ পাতা নেই সোনালি লতা নেই শিশির কণা নেই 
ঘাসের শিখা নেই জলের রেখা নেই 
আমার মরুভূর গোপন কোনো কোণে একটু নীল হয়ে 
বাতাসে কেঁপে কেঁপে একটি শীষ আজ উঠুক 

আমার গাছে গাছে আজ একটি কুঁড়ি নেই 
একটি পাতা নেই শুকনো ডালে ডালে বায়ুর ঘষা লেগে 
আগুন জ্ব’লে ওঠে তীব্র লেলিহান 
বাকল ছিঁড়েফেড়ে দুপুর ভেঙেচুরে আকাশ লাল ক’রে 
আমার গাছে আজ একটা ছোট ফুল ফুটুক 

আমার এ-আকাশ ছড়িয়ে আছে ওই 
পাতটিনের মতো ধাতুর চোখ জ্বলে প্রখর জ্বালাময় 
সে-তাপে গ’লে পড়ে আমার দশদিক 
জল ও বায়ুহীন আমার আকাশের অদেখা দূর কোণে 
বৃষ্টিসকাতর একটু মেঘ আজ জমুক 

আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল 
তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে 
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে 
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আজ দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে 
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক। 

৫.           ভালো থেকো
             হুমায়ুন আজাদ 


ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো। 
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো। 
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা। 
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা। 
ভালো থেকো। 

ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো। 
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো। 
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির। 
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর। 
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো। 
ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো। 
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ। 
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি। 
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো। 
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো। 
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল, 
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল, 
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো। 
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো। 
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।

৬. ফুলেরা জানতো যদি 
      হুমায়ুন আজাদ 

মুলঃ হেনরিক হাইনে 
ফুলেরা জানতো যদি আমার হৃদয় 
ক্ষতবিক্ষত কতোখানি, 
অঝোরে ঝরতো তাদের চোখের জল 
আমার কষ্ট আপন কষ্ট মানি । 

নাইটিংগেল আর শ্যামারা জানতো যদি 
আমার কষ্ট কতোখানি-কতোদুর, 
তাহলে তাদের গলায় উঠতো বেজে 
আরো ব হু বেশী আনন্দদায়ক সুর । 

সোনালী তারারা দেখতো কখনো যদি 
আমার কষ্টের অশ্রুজলের দাগ, 
তাহলে তাদের স্থান থেকে নেমে এসে 
জানাতো আমাকে সান্ত্বনা ও অনুরাগ । 

তবে তারা কেউ বুঝতে পারেনা তা- 
একজন,শুধু একজন,জানে আমার কষ্ট কতো; 
আমার হৃদয় ছিনিয়ে নিয়েছে যে 
ভাংগার জন্য-বারবার অবিরত । 


৭. প্রেমিকার মৃতুত্যে
        হুমায়ুন আজাদ 

খুব ভালো চমৎকার লাগছে লিলিআন,  
মুহুর্মুহু বিস্ফোরণে হবো না চৌচির।  
তরঙ্গে তরঙ্গে ভ্রষ্ট অন্ধ জলযান  
এখন চলবে জলে খুব ধীরস্থির।  
অন্য কেউ ঢেলে নিচ্ছে ঠোঁট থেকে লাল  
মাংস খুঁড়ে তুলে নিচ্ছে হীরেসোনামণি;  
এই ভয়ে কাঁপবে না আকাশপাতাল,  
থামবে অরণ্যে অগ্নি আকাশে অশনি।   
  
আজ থেকে খুব ধীরে পুড়ে যাবে চাঁদ,  
খুব সুস্থ হয়ে উঠবে জীবনযাপন।  
অন্নে জলে ঘ্রাণে পাবো অবিকল স্বাদ,  
চিনবো শত্রুর মুখে কারা-বা আপন।  
বুঝবো নিদ্রার জন্যে রাত্রি চিরদিন,  
যারা থাকে ঘুমহীন তারা গায় গান।  
রঙিন রক্তের লক্ষ্য ঠাণ্ডা কফিন;  
খুব ভালো চমৎকার লাগছে লিলিআন।  

৮. তোমার ক্ষমতা
    হুমায়ুন আজাদ 

তুমি ভাঙতে পারো বুক শুষে নিতে পারো সব রক্ত ও লবণ  
বিষাক্ত করতে পারো ঘুম স্বপ্নময় ঘুমের জগত  
তছনছ ক’রে দিতে পারো তুমি বন উপবন  
উল্টেপাল্টে দিতে পারো সব সিঁড়ি লিফট্ রাজপথ   
  
মিশিয়ে দিতেও পারো সঙ্গীতের সুরেসুরে বিষ  
আমাকে প্রগাঢ় কোনো আত্নহত্যায় উৎসাহিত ক’রে দিতে পারো  
ম’রে যাবে ধানক্ষেত ঝ’রে যাবে পাখিদের শিস  
তোমার ক্ষমতা আছে পারো তুমি আরো   
  
আমাকে মাতাল ক’রে ছেড়ে দিতে পারো তুমি গলির ভেতরে  
সমস্ত সড়কে তুমি জ্বালতে পারো লাল সিগনাল  
বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ ক’রে দিতে পারো জীবনের সবগুলো ঘরে  
এর বেশি আর তুমি কি পারো তমাল?  

৯. সেই কবে থেকে
   হুমায়ুন আজাদ 

সেই কবে থেকে জ্বলছি 
জ্ব’লে জ্ব’লে নিভে গেছি ব’লে 
তুমি দেখতে পাও নি।  

সেই কবে থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি 
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতিস্তম্ভের মতো ভেঙে পড়েছি ব’লে 
তুমি লক্ষ্য করো নি।  

সেই কবে থেকে ডাকছি 
ডাকতে ডাকতে স্বরতন্ত্রি ছিঁড়ে বোবা হয়ে গেছি ব’লে 
তুমি শুনতে পাও নি‘।  

সেই কবে থেকে ফুটে আছি 
ফুটে ফুটে শাখা থেকে ঝ’রে গেছি ব’লে 
তুমি কখনো তোলো নি।  

সেই কবে থেকে তাকিয়ে রয়েছি 
তাকিয়ে তাকিয়ে অন্ধ হয়ে গেছি ব’লে 
একবারো তোমাকে দেখি নি। 

১০. আত্মহত্যার অস্ত্রাবলি
          হুমায়ুন আজাদ 

রয়েছে ধারালো ছোরা স্লিপিং টেবলেট  
কালো রিভলবার  
মধ্যরাতে ছাদ  
ভোরবেলাকার রেলগাড়ি  
সারিসারি বৈদ্যুতিক তার।   
  
স্লিপিং টেবলেট খেয়ে অনায়াসে ম’রে যেতে পারি  
বক্ষে ঢোকানো যায় ঝকঝকে উজ্জ্বল তরবারি  
কপাল লক্ষ্য ক’রে টানা যায় অব্যর্থ ট্রিগার  
ছুঁয়ে ফেলা যায় প্রাণবাণ বৈদ্যুতিক তার  
ছাদ থেকে লাফ দেয়া যায়  
ধরা যায় ভোরবেলাকার রেলগাড়ি  
অজস্র অস্ত্র আছে  
যে-কোনো একটি দিয়ে আত্মহত্যা ক’রে যেতে পারি   
  
এবং রয়েছো তুমি  
সবচেয়ে বিষাক্ত অস্ত্র প্রিয়তমা মৃত্যুর ভগিনী  
তোমাকে ছুঁলে  
দেখলে এমনকি তোমার নাম শুনলে  
আমার ভেতরে লক্ষ লক্ষ আমি আত্মহত্যা করি।  

১১. বাঙলা ভাষা
   হুমায়ুন আজাদ 

শেকলে বাঁধা শ্যামল রূপসী, তুমি-আমি, দুর্বিনীত দাসদাসী-  
একই শেকলে বাঁধা প’ড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী।  
আমাদের ঘিরে শাঁইশাঁই চাবুকের শব্দ, স্তরে স্তরে শেকলের ঝংকার।  
তুমি আর আমি সে-গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায়-  
হাহাকার রূপান্তরিত হয় সঙ্গীতে-শোভায়।   
  
লকলকে চাবুকের আক্রোশ আর অজগরের মতো অন্ধ শেকলের  
মুখোমুখি আমরা তুলে ধরি আমাদের উদ্ধত দর্পিত সৌন্দর্য:  
আদিম ঝরনার মতো অজস্র ধারায় ফিনকি দেয়া টকটকে লাল রক্ত,  
চাবুকের থাবায় সুর্যের টুকরোর মতো ছেঁড়া মাংস  
আর আকাশের দিকে হাতুড়ির মতো উদ্যত মুষ্টি।   
  
শাঁইশাঁই চাবুকে আমার মিশ্র মাংসপেশি পাথরের চেয়ে শক্ত হয়ে ওঠে  
তুমি হয়ে ওঠো তপ্ত কাঞ্চনের চেয়েও সুন্দর।  
সভ্যতার সমস্ত শিল্পকলার চেয়ে রহস্যময় তোমার দু-চোখ  
যেখানে তাকাও সেখানেই ফুটে ওঠে কুমুদকহ্লার  
হরিণের দ্রুত ধাবমান গতির চেয়ে সুন্দর ওই ভ্রূযুগল  
তোমার পিঠে চাবুকের দাগ চুনির জড়োয়ার চেয়েও দামি আর রঙিন  
তোমার দুই স্তন ঘিরে ঘাতকের কামড়ের দাগ মুক্তোমালার চেয়েও ঝলোমলো  
তোমার ‘অ, আ’ –চিৎকার সমস্ত আর্যশ্লোকের চেয়েও পবিত্র অজর   
  
তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চন্ডীদাস  
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন  
তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ  
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ  
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম   
  
শাঁইশাঁই চাবুকের আক্রোশে যখন তুমি আর আমি  
আকাশের দিকে ছুঁড়ি আমাদের উদ্ধত সুন্দর বাহু, রক্তাক্ত আঙুল,  
তখনি সৃষ্টি হয় নাচের নতুন মুদ্রা;  
ফিনকি দেয়া লাল রক্ত সমস্ত শরীরে মেখে যখন আমরা গড়িয়ে পড়ি  
ধূসর মাটিতে এবং আবার দাঁড়াই পৃথিবীর সমস্ত চাবুকের মুখোমুখি,  
তখনি জন্ম নেয় অভাবিত সৌন্দর্যমন্ডিত বিশুদ্ধ নাচ;  
এবং যখন শেকলের পর শেকল চুরমার ক’রে ঝনঝন ক’রে বেজে উঠি  
আমরা দুজন, তখনি প্রথম জন্মে গভীর-ব্যাপক-শিল্পসম্মত ঐকতান-  
আমাদের আদিগন্ত আর্তনাদ বিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের একমাত্র গান।  

১২. গোলাপ ফোটাবো
        হুমায়ুন আজাদ 

ওষ্ঠ বাড়িয়ে দাও গোলাপ ফোটাবো,  
বঙ্কিম গ্রীবা মেলো ঝরনা ছোটাবো।  
যুগল পাহাড়ে পাবো অমৃতের স্বাদ,  
জ্ব’লে যাবে দুই ঠোঁটে একজোড়া চাঁদ।  
সুন্দরীর নৌকো ঢুকাবো বঙ্গোপসাগরে,  
অতলে ডুববো উত্তাল আশ্বিনের ঝড়ে।  
শিউলির বোঁটা থেকে চুষে নেবো রস,  
এখনো আমার প্রিয় আঠারো বয়স।  
তোমার পুষ্পের কলি মধুমদগন্ধময়,  
সেখানে বিন্দু বিন্দু জমে আমার হৃদয়। 


আমাদের এই কবিতা গুলো  কষ্ট করে পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য  ধন্যবাদ।আমার লেখার ভিতর অনেক কোনো ভুল হয়ে থাকে, প্লিজ আমাকে ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।
পরবর্তী পর্বের পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।

No comments

Theme images by diane555. Powered by Blogger.