কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী কবিতা-সমূহ
আসসালামু আলাইকুম, বন্ধুরা সবাই কেমন আছেন,,,??আশা করি সবাই ভালো আছেন। Technical Bangla পক্ষ থেকে আমি নয়ন আছি আপনাদের সাথে,,,,,বরারবে মতো আবারও আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।
হ্যালো বন্ধুরা কবিতা পর্ব-১৭: তে আপনাদের আবার স্বাগতম।সবাই মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।কবিতা গুলো আপনার ভালো লাগলে সবার মাঝে শেয়ার করুন। আজকে আমি নিয়ে এসেছি কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী এর লেখা ১১ টি কবিতা।
চলুন দেখে আসি কবিতা গুলো-
১. অপরাজিতা
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
পরাজিতা তুই সকল ফুলের কাছে,
তবু কেন তোর অপরাজিতা নাম?
গন্ধ কি তোর বিন্দুমাত্র আছে?
বর্ণ-সেও ত নয় নয়নাভিরাম।
ক্ষুদ্র সেফালি, তারও মধুর-সৌরভ;
ক্ষুদ্র অতসী, তারো কাঞ্চন-ভাতি;
গরবিণি, তোর কিসে তবে গৌরব!
রূপগুণহীন বিড়ম্বনার খ্যাতি!
কালো আঁখিপুটে শিশির-অশ্রু ঝরে---
ফুল কহে---মোর কিছু নাই কিছু নাই,
তোমরা যে নামে ডাকিয়াছ দয়া করে,
আমি শুধু ভাই, তাই---আমি শুধু তাই।
ফুলসজ্জায় লজ্জায় যাই নাক,
পুষ্পমালায় নাহিক আমার স্থান,
প্রিয় উপহারে ভুলেও কি মোরে ডাক?
বিবাহ-বাসরে থাকি আমি ম্রিয়মাণ।
মোর ঠাঁই শুধু দেবের চরণতলে,
পূজা-শুধু-পূজা জীবনের মোর ব্রত;
তিনিও কি মোরে ফিরাবেন আঁখিজলে---
অন্তরযামী,---তিনিও তোমারি মত?
২. অন্ধ বধূ
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
পায়ের তলায় নরম ঠেকল কি!
আস্তে একটু চল না ঠাকুর-ঝি---
ওমা, এযে ঝরা-বকুল! নয়?
তাইত বলি, বসে' দোরের পাশে,
রাত্তিরে কাল---মধুমদির বাসে
আকাশ-পাতাল কতই মনে হয়।
জ্যৈষ্ঠ আসতে কদিন দেরী ভাই---
আমের গায়ে বরণ দেখা যায়?
--অনেক দেরী? কেমন করে' হবে!
কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে,
দখিণ হাওয়া---বন্দ কবে ভাই;
দীঘির ঘটে নতুন সিঁড়ি জাগে---
শেওলা-পিছল---এমনি শঙ্কা লাগে,
পা-পিছলিয়ে তলিয়ে যদি যাই!
মন্দ নেহাৎ হয় না কিন্তু তায়---
অন্ধ চোখের দ্বন্দ্ব চুকে' যায়!
দুঃখ নাইক সত্যি কথা শোন্,
অন্ধ গেলে কি আর হবে বোন?
বাঁচবি তোরা---দাদা ত তোর আগে;
এই আষাঢ়েই আবার বিয়ে হবে,
বাড়ী আসার পথ খুঁজে' না পাবে---
দেখবি তখন প্রবাস কেমন লাগে?
--কি বল্লি ভাই, কাঁদবে সন্ধ্যা-সকাল?
হা অদৃষ্ট, হায়রে আমার কপাল!
কত লোকেই যায় ত পরবাসে---
কাল-বোশেখে কে না বাড়ী আসে?
চৈতালি কাজ, কবে যে সেই শেষ!
পাড়ার মানুষ ফিরল সবাই ঘর,
তোমার ভাইয়ের সবই স্বতন্তর---
ফিরে' আসার নাই কোন উদ্দেশ!
--ঐ য়ে হেথায় ঘরের কাঁটা আছে---
ফিরে' আসতে হবে ত তার কাছে!
এইখানেতে একটু ধরিস ভাই,
পিছল ভারি --- ফস্ কে যদি যাই---
এ অক্ষমার রক্ষা কি আর আছে!
আসুন ফিরে'---অনেক দিনের আশা,
থাকুন ঘরে, না থাক্ ভালবাসা---
তবু দুদিন অভাগিনীর কাছে!
জন্মশোধের বিদায় নিয়ে ফিরে'---
সেদিন তখন আসব দীঘির তীরে।
চোখ গেল ঐ চেঁচিয়ে হ'ল সারা!
আচ্ছা দিদি, কি করবে ভাই তারা---
জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ!
কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার---ছাই!
কাঁদতে পেলে বাঁচত সে যে ভাই,
কতক তবু কমত যে তার শোক!
চোখ গেল ---তার ভরসা তবু আছে---
চক্ষুহীনার কি কথা কার কাছে!
টানিস কেন? কিসের তাড়াতাডি---
সেই ত ফিরে' যাব আবার বাড়ী,
একলা থাকা সেই ত গৃহকোণ---
তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে
দুটো যেন প্রাণের কথা বলে---
দরদ-ভরা দুখের আলাপন;
পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মত
ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত!
এবার এলে, হাতটি দিয়ে গায়ে
অন্ধ আঁখি বুলিয়ে বারেক পায়ে---
বন্দ চোখের অশ্রু রুধি' পাতায়,
জন্ম-দুখীর দীর্ঘ আয়ু দিয়ে
চিরবিদায় ভিক্ষা যাব নিয়ে---
সকল বালাই বহি আপন মাথায়!
দেখিস তখন, কাণার জন্য আর
কষ্ট কিছু হয়না যেন তাঁর।
তার পরে---এই শেওলা-দীঘির ধার---
সঙ্গে আসতে বলবো নাক আর,
শেষের পথে কিসের বল' ভয়---
এইখানে এই বেতের বনের ধারে,
ডাহুক-ডাকা সন্ধ্যা-অন্ধকারে---
সবার সঙ্গে সাঙ্গ পরিচয়!
শেওলা-দীঘির শীতল অতল নীরে---
মায়ের কোলটি পাই যেন ভাই ফিরে'!
৩. ভালবাসার জয়
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
ও ভাই, ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে-
গোলাগুলির গোলাতে নয়, গভীর ভালবেসে।
খড়ুগ, সায়ক, শাণিত তরবার,
কতটুকুন সাধ্য তাহার, কি বা তাহার ধার?
শত্রুকে সে জিনতে পারে, কিনতে নারে যে সে-
ও তার স্বভাব সর্বনেশে।
ভালবাসায় ভুবন করে জয়,
সখ্যে তাহার অশ্রুজলে শত্রু মিত্র হয়-
সে যে সৃজন পরিচয়।
শত আঘাত-ব্যথা-অপমানে লয় সে কোলে এসে,
মৃত্যুরে সে বন্ধু বলে ধরে শেষে।
৪. যৌবন-চাঞ্চল্য
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
ভুটিয়া যুবতি চলে পথ;
আকাশ কালিমামাখা কুয়াশায় দিক ঢাকা।
চারিধারে কেবলই পর্বত;
যুবতী একেলা চলে পথ।
এদিক-ওদিক চায় গুনগুনি গান গায়,
কভু বা চমকি চায় ফিরে;
গতিতে ঝরে আনন্দ উথলে নৃত্যের ছন্দ
আঁকাবাঁকা গিরিপথ ঘিরে।
ভুটিয়া যুবতি চলে পথ।
টসটসে রসে ভরপুর--
আপেলের মত মুখ আপেলের মত বুক
পরিপূর্ণ প্রবল প্রচুর;
যৌবনের রসে ভরপুর।
মেঘ ডাকে কড়-কড় বুঝিবা আসিবে ঝড়,
একটু নাহিকো ডর তাতে;
উঘারি বুকের বাস, পুরায় বিচিত্র আশ
উরস পরশি নিজ হাতে!
অজানা ব্যাথায় সুমধুর--
সেথা বুঝি করে গুরুগুরু!
যুবতি একেলা পথ চলে;
পাশের পলাশ-বনে কেন চায় অকারণে?
আবেশে চরণ দুটি টলে--
পায়ে-পায়ে বাধিয়া উপলে!
আপনার মনে যায় আপনার মনে গায়,
তবু কেন আনপানে টান?
করিতে রসের সৃষ্টি চাই কি দশের দৃষ্টি?
--স্বরূপ জানেন ভগবান!
সহজে নাচিয়া যেবা চলে
একাকিনী ঘন বনতলে--
জানি নাকো তারো কী ব্যাথায়
আঁখিজলে কাজল ভিজায়!
৫. কাজলা দিদি
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;-
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন,
ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,
আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে।
ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল।
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,-
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে’
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই
রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
৬. দাসীপুত্র
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
পরের দুয়ারে দাসী বটে আজি, তবু সে মোদেরই মা,---
ভুলিবারে চাই সতত সে কথা ; ভুলিবারে পারি না।
কাঙালের ঘরে যাহা কিছু জোটে, সে যে ধূলিমাখা খুদ,
উপবাস ক্ষীণ শীর্ণ বক্ষে শুকায়ে গিয়াছে দুধ,---
তবু তাই খেয়ে বাঁচে এই প্রাণ, তাই দিয়ে এই দেহ,
ধূলামাটি মাখা তাহারই অঙ্কে বাঁধি দুদিনের গেহ,
হাঁটিতে শিখেছি যার হাঁটু ধরে, যে বুকে মেলিয়া পা,
হক ভিখারিনী---তবু সে জননী, কেমনে ভুলিব তা?
মাতা বিনতার দুখের দুলাল, মানুষ নয় সে, পাখি!
মায়ের দুঃখ-ভরা দাসীত্ব ঘুচাইয়াছিল না কি?
যতই এ-হিয়া উঠে গুমরিয়া বিপদ-বেদনা-বিষে,
মানুষের ঘরে জন্ম লভিয়া সে-কথা ভুলিব কিসে?
কোথা প্রাণপণ প্রবল নিষ্ঠা, চিত্ত অকুতোভয়,
কই সে বেদনা, শক্তিসাধনা, পণ মৃত্যুঞ্জয়?
প্রচণ্ড তেজ চাই সে গরুড়---আমাদেরই মাঝে চাই,
অমৃতের লাগি সেই প্রাণপণ--- ভুলিবনা ভুলি নাই।
এস তপস্বী, উগ্রশক্তি, এস হে কর্মবীর,
কর দৃঢ় পণ মায়ের চক্ষে মুছাতে অশ্রুনীর;
পায়ে-পায়ে যত বিভেদের বাধা ভুলায়ে পরস্পরে
ভায়ে ভায়ে আজি মিলাইতে হবে জননীর ভাঙা ঘরে;
এস হে হিন্দু, এস খ্রীষ্টীয়, পারসী, মুসলমান
যে মায়ের বুকে জন্ম তোমার, রাখ আজি তার মান।
যে জননী আজ ভিখারিনী হয়ে ভুলেছে আপন বাণী,
অর্জিয়া তারি ধর্মরাজ্য কর তাঁরে রাজরাণী।
৭. মাধবিকা
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
দখিন হাওয়া---রঙিন হাওয়া, নূতন রঙের ভাণ্ডারী,
জীবন-রসের রসিক বঁধু, যৌবনেরি কাণ্ডারী!
সিন্ধু থেকে সদ্দ বুঝি আসছ আজি স্নান করি'---
গাং-চিলেদের পক্ষধ্বনির শন্ শনানির গান্ ধরি';
মৌমাছিদের মনভুলানি গুনগুনানির সুর ধরে'---
চললে কোথায় মুগ্ধ পথিক, পথটি বেয়ে উত্তরে?
অনেক দিনের পরে দেখা, বছর-পারের সঙ্গী গো,
হোক্ না হাজার ছাড়াছাড়ি, রেখেছ সেই ভঙ্গি তো!
---তেমনি সরস ঠাণ্ডা পরশ, তেমনি গলার হাঁকটি , সেই
দেখতে পেলেই চিনতে পারি, কোনোখানেই ফাঁকটি নেই!
---কোথায় ছিলে বন্ধু আমার, কোন্ মলয়ের বন ঘিরে,'
নারিকেলের কুঞ্জে-বেড়া কোন্ সাগরের কোন্ তীরে!
লকলকে সেই বেতসবীথির বলো তো ভাই কোন্ গলি,
এলা-লতার কেয়াপাতার খবর তো সব মঙ্গলই?
---ভালো কথা, দেখলে পথে সবাই তোমায় বন্দে তো,---
বন্ধু বলে' চিনতে কারো হয়নি তো ভাই সন্দেহ?
নরনারী তোমার মোহে তেমনি তো সব ভুল করে---
তেমনিতর পরস্পরের মনের বনে ফুল ধরে!
আসতে যেতে দীঘির পথে তেমনি নারীর ছল করা;
পথিকবধুর চোখের কোণে তেমনি তো সেই জলভরা?
রঙ্গনে সেই রং তো আছে, অশোকে তাই ফুটছে তো,
শাখায় তারি দুলতে দোলায় তরুণীদল জুটছে তো?
তোমায় দেখে' তেমনি দেখে উঠছে তো সব বিহঙ্গ,
সবুজ ঘাসের শীষটি বেয়ে রয় তো চেয়ে পতঙ্গ?
তেমনি---সবই তেমনি আছে! --- হ'লাম শুনে' খুব খুশী,
প্রাণটা ওঠে চনচনিয়ে, মনটা ওঠে উসখুসি', ---
নূতন রসে রসল হৃদয়, রক্ত চলে চঞ্চলি', ---
বন্ধু তোমায় অর্ঘ্য দিলাম উচ্ছলিত অঞ্জলি।
গ্রহণ করো, গ্রহণ করো---বন্ধু আমার দণ্ডেকের---
জানিনাক আবার কবে দেখা তোমার সঙ্গে ফের।।
৮. দ্বিপ্রহরে
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
বইয়ের পাতায় মন বসেনা, খোলা পাতা খোলাই পড়ে’ থাকে,
চোখের পাতায় ঘুম আসেনা---- দেহের ক্লান্তি বুঝাই বলো কা’কে?
কাজের মাঝে হাত লাগাব, কোথাও কোন’ উত্সাহ নাই তার,
চেয়ে আছি চেয়েই আছি, চাওয়ার তবু নাইক কিছু আর !
বেলা বাড়ে, রোদ চড়ে’ যায়, প্রখর রবি দহে আকাশ তল,
ঝাঁঝাঁ করে ভিতর-বাহির, চোখের পথে শুকায় চোখের জল;
মোহাচ্ছন্ন মৌন জগৎ, কোথাও যেন জীবনচেষ্টা নাহি,
ক্লিষ্ট আকাশ নির্ণিমেষে দিনের দাহ দেখছে শুধু চাহি’!
ঘরে ঘরে আগল আঁটা, আমার ঘরেই মুক্ত শুধু দ্বার,
সেই যে খুলে’ চলে’ গেছে তেম্ নি আছে, কে দেয় উঠে’ আর !
পথের ধারে নিমের গাছে একটি কেবল তিক্ত মধুর শ্বাস
ক্ষণে ক্ষণে জানায় শুধু গোপন বুকের উদাসী উচ্ছ্বাস!
হাহা করে তপ্ত হাওয়া শষ্যহারা বসন্ত-শেষ মাঠে,
চোতের ফসল বিকিয়ে গেছে কবে কোথায় অজানা কোন্ হাটে!
উদার মলয় নিঃস্ব আজি, সাম্ নে শুধু ধূসর বালুচর
পঞ্চতপা দিক্-বিধবার বসন খানি লুট্ ছে নিরন্তর!
কোন্ পথে সে গেছে চলি’ মরু-বেলায় চিহ্নটি নাই তার,
লুপ্ত সকল শ্যামলিমা লয়ে তাহার মুগ্ধ উপাচার;
জাগ্ ছে শুধু প্রখর দাহ তৃষ্ণাভরা বিশুষ্ক জিহ্বায়
দিনান্ত সে আস্ বে কখন ? দম্ কা বাতাস ধমক্ দিয়ে যায়!
৯. কলঙ্ক
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
বাতাবিকুঞ্জে সন্ধ্যার বায় পুষ্পপরাগচোর------
কলঙ্কী মন, চেয়ে দেখ্ আজি সঙ্গী মিলেছে তোর।
দিবা অবসান, রবি হ’ল রাঙা,
পশ্চিমাকাশে নট্ কনা -ভাঙা;
সঙ্গহীনের যাহা কিছু কাজ সাঙ্গ করেছি মোর,
কুঞ্জদুয়ারে ব’সে আছি একা কুসুমগন্ধে ভোর!
আধফুটন্ত বাতাবিকুসুমে কানন ভরিয়া আছে,----
কি গোপন কথা গুঞ্জরি’ অলি ফিরিছে ফুলের কাছে!
ফুটনোন্মুখ ফুলদলগুলি
পুলক-পরশে উঠে দুলিদুলি
গন্ধভিখারী সন্ধ্যার বায় ফুলপরিমল যাচে-----
সঙ্কোচে নত পুষ্পবালিকা---অতিথি ফিরে বা পাছে!
বেলা বয়ে যায়, সন্ধ্যার বায় আসি’ কহে বার বার,
সন্ধ্যা হয় যে অন্ধ কুসুম-----খোলো অন্তর-দ্বার!
মুকুলগন্ধ অন্ধ ব্যথায়
কুঁড়ির বন্ধ টুটিবারে চায়,
লুটাইতে চায় সন্ধ্যার পায় রুদ্ধ আবেগভার,
বিকাইতে চায় চরণের পরে কৌমার সুকুমার।
মন্থরপদে সন্ধ্যা নামিছে কাজলতিমিরে আঁকা,
দুয়ারে অতিথি, অন্তরে ব্যথা--- সম্ভব সে কি থাকা?
গন্ধে পাগল অন্তর যার,
আবরণ মাঝে থাকে সে কি আর,
খুলি’ দিল দ্বার, পরান তাহার পরাগে-শিশিরে মাখা;
কুঞ্জ ঘিরিয়া আঁধারে ছাইল স্বপ্নপাখীর পাখা।
বাতাবিকুঞ্জে সন্ধ্যার বায় পুষ্পপরাগচোর----
হা রে কলঙ্কী হৃদয় আমার, সঙ্গী মিলেছে তোর।
দূরদিগন্তে দিবা হল সারা;
অন্তর ভরি ফুটে’ উঠে তারা,
নব-ফুটন্ত নেবুর গন্ধে আসিল তন্দ্রাঘোর-----
কলঙ্কী প্রেম, মুগ্ধ হৃদয়-----একই "পরিণাম তোর।
১০. কেয়াফুল
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
ফুল চাই ---- চাই কেয়াফুল!----
সহসা পথের ‘পরে
আমার এ ভাঙ্গা ঘরে
কন্ঠ কার ধ্বনিল আকুল।
তখনো শ্রাবণ-সন্ধ্যা
নিঃশেষে হয়নি বন্ধ্যা-----
থেকে থেকে ঝরিতেছে জল;
পবন উঠিছে জেগে,
বিজলী ঝলিছে বেগে------
মেঘে মেঘে বাজিছে মাদল।
জনহীন ক্ষুব্ধ পথ
জাগিছে দুঃস্বপ্নবৎ----
বুকে চাপি’ আর্ত্ত অন্ধকার;
কোনমতে কাজ সারি’
যে যার ফিরিছে বাড়ী,
ঘরে ঘরে বন্ধ যত দ্বার।
শূন্য ঘরে
হিয়া গুমরিয়া মরে
স্মরি’ যত জীবনের ভুল;
অকস্মাৎ তারি মাঝে
ধ্বনি কার কানে বাজে-----
চাই ফুল----চাই কেয়াফুল!
পাগল! আজি এ রাতে
এ দুর্য্যোগ-অভিঘাতে----
বৃষ্টিপাতে বিলুপ্ত মেদিনী;
তার মাঝে কে আছে,
কেতকী-সৌরভ যাচে!
কোথায় বা হবে বিকিকিনি?
পবন উঠিছে মাতি!
কিছুক্ষণ কান পাতি’
মনে হ’ল গিয়াছে বালাই;
সহসা আমারি দ্বারে
ডাক এল একেবারে----
চাই ফুল --- কেয়াফুল চাই!
ভাবিলাম মনে মনে-----
হয়ত বা এ জীবনে
কোনোদিন কিনেছিনু ফুল;
সেই কথা মনে ক’রে
আজো বা আশায় ঘোরে;
কিম্বা কারে করিয়াছে ভুল!
তাড়াতাড়ি আলো তুলি’
বাহিরিনু দ্বার খুলি,
সবিস্ময়ে দেখিলাম চেয়ে----
মাথায় বৃহৎ ডালা,
দাঁড়ায়ে পসারী-বালা-----
শ্রাবণ ঝরিছে অঙ্গ বেয়ে;
কহিলাম, এ কি কান্ড!
তোমার পসরাভান্ড
আজ রাতে কে কিনিবে আর ?
এ প্রলয়ে কারো কাছে
কিছু কি প্রত্যাশা আছে-----
কেন মিছে বহিছ এ ভার!
আর্দ্র দেহে আর্দ্র বাসে
সে কহিল মৃদু হাসে,-----
শিরে বায়ু সুগন্ধ ছড়ায়----
যে ফুল বেসাতি করি,
বাদল যে শিরে ধরি,-----
কপালে লিখিল বিধি তাই!
বহিয়া দুখের ঋণ
যে কষ্টে কাটাই দিন-----
এ দুর্দ্দিন কিবা তার কাছে?
ওগো তুমি নেবে কিছু?
নয়ন হইল নীচু----
সেথাও বা মেঘ নামিয়াছে!
খোলা দরজার পাশে
বায়ু গরজিয়া আসে,
ফুলবাসে ভরি দেহ-মন;
ঝর-ঝর ঝরে জল,
আঁখি করে ছল-ছল
ঘনাইয়া প্রাণের শ্রাবণ!
বাদলের বিহ্বলতা----
বুঝি হায়! লাগিল তা’
নয়নে বচনে সর্ব্ব দেহে;
সহসা চাহিয়া আড়
রমণী ফিরাল ঘাড়-----
উর্দ্ধে যেন কি দেখিবে চেয়ে!
না কহিয়া কোন বাণী
পসরা লইনু টানি’-----
মূল্য তার হাতে দিনু যবে,
উজার করিতে ডালা
কাঁদিয়া ফেলিল বালা------
ওমা এ কি ---- এত কেন হবে?
কহিনু ---যা’ কিনিলাম,
এ নহে তাহারি দাম-----
প্রতিদিন দিতে হবে মোরে;
এক পণ দুই পণ----
যেদিন যেমন মন,
তাহারি আগাম দিনু তোরে;
কতক বুঝে’ না-বুঝে’
হৃদয়ের ভাষা খুঁজে’
বহুকষ্টে জানাইয়া তাই,
পুষ্পগন্ধে মোরে ঘিরে’
অন্ধকারে ধীরে-ধীরে
পসারিনী লইল বিদায়।
ফিরিনু একলা ঘরে-----
বাদল তখনো ঝরে,
পুষ্পগন্ধে পূর্ণ গৃহতল;
শয্যা লইলাম পাতি’
নিবায়ে দিলাম বাতি----
আবার আসিল বেগে জল!
রুদ্ধ জানালার ফাঁকে
বাতাস কাহারে ডাকে,
বিজলী চমকি’ কারে চায়!
কোন্ অন্ধ অনুরাগে
ত্রিযামা যামিনী জাগে
শ্রাবণ ব্যাকুল-ব্যর্থতায়!
সঙ্গীহীন শূন্য ঘরে
হিয়া গুমরিয়া মরে----
স্মরিয়া এ জীবনের ভুল;
সেই সাথে থেকে- থেকে
মনে হয় --- গেল ডেকে’
কাননের যত কেয়াফুল!
১১. কর্ম
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
শক্তি মায়ের ভৃত্য মোরা- নিত্য খাটি নিত্য খাই,
শক্ত বাহু, শক্ত চরণ, চিত্তে সাহস সর্বদাই।
ক্ষুদ্র হউক, তুচ্ছ হউক, সর্ব সরম-শঙ্কাহীন---
কর্ম মোদের ধর্ম বলি কর্ম করি রাত্রি দিন।
চৌদ্দ পুরুষ নিঃস্ব মোদের - বিন্দু তাহে লজ্জা নাই,
কর্ম মোদের রক্ষা করে অর্ঘ্য সঁপি কর্মে তাই।
সাধ্য যেমন - শক্তি যেমন - তেমনি অটল চেষ্টাতে--
দুঃখে-সুখে হাস্যমুখে কর্ম করি নিষ্ঠাতে।
কর্মে ক্ষুধার অন্ন যোগায়, কর্মে দেহে স্বাস্থ্য পাই;
দুর্ভাবনায় শান্তি আনে --- নির্ভাবনায় নিদ্রা যাই।
তুচ্ছ পরচর্চাগ্লানি--- মন্দ ভালো--- কোন্ টা কে---
নিন্দা হতে মুক্তি দিয়া হাল্কা রেখে মনটাকে।
পৃথ্বি-মাতার পুত্র মোরা, মৃত্তিকা তার শয্যা তাই;
পুষ্পে-তৃণে বাসটি ছাওয়া, দীপ্তি-হাওয়া ভগ্নী-ভাই।
তৃপ্তি তাঁরি শস্যে-জলে ক্ষুত্ পিপাসা দুঃসহ।
মুক্ত মাঠে যুক্ত করে বন্দি তাঁরেই প্রত্যহ।
ক্ষুদ্র নহি - তুচ্ছ নহি - ব্যর্থ মোরা নই কভু।
অর্থ মোদের দাস্য করে - অর্থ মোদের নয় প্রভু।
স্বর্ণ বল, রৌপ্য বল, বিত্তে করি জন্মদান,
চিত্ত তবু রিক্ত মোদের নিত্য রহে শক্তিমান।
কীর্তি মোদের মৃত্তিকাতে প্রত্যহ রয় মুদ্রিত,
শুণ্য' পরে নিত্য হের স্তোত্র মোদের উদ্গীত।
সিন্ধুবারি পণ্য বহি' ধন্য করে তৃপ্তিতে,
বহ্নি' মোদের রুদ্র প্রতাপ ব্যক্ত করে দীপ্তিতে।
বিশ্ব জুড়ি' সৃষ্টি মোদের, হস্ত মোদের বিশ্বময়,
কাণ্ড মোদের, সর্বঘটে - কোন্ খানে তা দৃষ্য নয়?
বিশ্বনাথের যজ্ঞশালে কর্মযোগের অন্ত নাই,
কর্ম সে যে ধর্ম মোদের, -- কর্ম চাহি -- কর্ম চাই।
আমাদের এই কবিতা গুলো কষ্ট করে পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।আমার লেখার ভিতর অনেক কোনো ভুল হয়ে থাকে, প্লিজ আমাকে ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।
পরবর্তী পর্বের পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।
হ্যালো বন্ধুরা কবিতা পর্ব-১৭: তে আপনাদের আবার স্বাগতম।সবাই মনোযোগ দিয়ে পড়বেন।কবিতা গুলো আপনার ভালো লাগলে সবার মাঝে শেয়ার করুন। আজকে আমি নিয়ে এসেছি কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচী এর লেখা ১১ টি কবিতা।
চলুন দেখে আসি কবিতা গুলো-
১. অপরাজিতা
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
পরাজিতা তুই সকল ফুলের কাছে,
তবু কেন তোর অপরাজিতা নাম?
গন্ধ কি তোর বিন্দুমাত্র আছে?
বর্ণ-সেও ত নয় নয়নাভিরাম।
ক্ষুদ্র সেফালি, তারও মধুর-সৌরভ;
ক্ষুদ্র অতসী, তারো কাঞ্চন-ভাতি;
গরবিণি, তোর কিসে তবে গৌরব!
রূপগুণহীন বিড়ম্বনার খ্যাতি!
কালো আঁখিপুটে শিশির-অশ্রু ঝরে---
ফুল কহে---মোর কিছু নাই কিছু নাই,
তোমরা যে নামে ডাকিয়াছ দয়া করে,
আমি শুধু ভাই, তাই---আমি শুধু তাই।
ফুলসজ্জায় লজ্জায় যাই নাক,
পুষ্পমালায় নাহিক আমার স্থান,
প্রিয় উপহারে ভুলেও কি মোরে ডাক?
বিবাহ-বাসরে থাকি আমি ম্রিয়মাণ।
মোর ঠাঁই শুধু দেবের চরণতলে,
পূজা-শুধু-পূজা জীবনের মোর ব্রত;
তিনিও কি মোরে ফিরাবেন আঁখিজলে---
অন্তরযামী,---তিনিও তোমারি মত?
২. অন্ধ বধূ
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
পায়ের তলায় নরম ঠেকল কি!
আস্তে একটু চল না ঠাকুর-ঝি---
ওমা, এযে ঝরা-বকুল! নয়?
তাইত বলি, বসে' দোরের পাশে,
রাত্তিরে কাল---মধুমদির বাসে
আকাশ-পাতাল কতই মনে হয়।
জ্যৈষ্ঠ আসতে কদিন দেরী ভাই---
আমের গায়ে বরণ দেখা যায়?
--অনেক দেরী? কেমন করে' হবে!
কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে,
দখিণ হাওয়া---বন্দ কবে ভাই;
দীঘির ঘটে নতুন সিঁড়ি জাগে---
শেওলা-পিছল---এমনি শঙ্কা লাগে,
পা-পিছলিয়ে তলিয়ে যদি যাই!
মন্দ নেহাৎ হয় না কিন্তু তায়---
অন্ধ চোখের দ্বন্দ্ব চুকে' যায়!
দুঃখ নাইক সত্যি কথা শোন্,
অন্ধ গেলে কি আর হবে বোন?
বাঁচবি তোরা---দাদা ত তোর আগে;
এই আষাঢ়েই আবার বিয়ে হবে,
বাড়ী আসার পথ খুঁজে' না পাবে---
দেখবি তখন প্রবাস কেমন লাগে?
--কি বল্লি ভাই, কাঁদবে সন্ধ্যা-সকাল?
হা অদৃষ্ট, হায়রে আমার কপাল!
কত লোকেই যায় ত পরবাসে---
কাল-বোশেখে কে না বাড়ী আসে?
চৈতালি কাজ, কবে যে সেই শেষ!
পাড়ার মানুষ ফিরল সবাই ঘর,
তোমার ভাইয়ের সবই স্বতন্তর---
ফিরে' আসার নাই কোন উদ্দেশ!
--ঐ য়ে হেথায় ঘরের কাঁটা আছে---
ফিরে' আসতে হবে ত তার কাছে!
এইখানেতে একটু ধরিস ভাই,
পিছল ভারি --- ফস্ কে যদি যাই---
এ অক্ষমার রক্ষা কি আর আছে!
আসুন ফিরে'---অনেক দিনের আশা,
থাকুন ঘরে, না থাক্ ভালবাসা---
তবু দুদিন অভাগিনীর কাছে!
জন্মশোধের বিদায় নিয়ে ফিরে'---
সেদিন তখন আসব দীঘির তীরে।
চোখ গেল ঐ চেঁচিয়ে হ'ল সারা!
আচ্ছা দিদি, কি করবে ভাই তারা---
জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ!
কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার---ছাই!
কাঁদতে পেলে বাঁচত সে যে ভাই,
কতক তবু কমত যে তার শোক!
চোখ গেল ---তার ভরসা তবু আছে---
চক্ষুহীনার কি কথা কার কাছে!
টানিস কেন? কিসের তাড়াতাডি---
সেই ত ফিরে' যাব আবার বাড়ী,
একলা থাকা সেই ত গৃহকোণ---
তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে
দুটো যেন প্রাণের কথা বলে---
দরদ-ভরা দুখের আলাপন;
পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মত
ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত!
এবার এলে, হাতটি দিয়ে গায়ে
অন্ধ আঁখি বুলিয়ে বারেক পায়ে---
বন্দ চোখের অশ্রু রুধি' পাতায়,
জন্ম-দুখীর দীর্ঘ আয়ু দিয়ে
চিরবিদায় ভিক্ষা যাব নিয়ে---
সকল বালাই বহি আপন মাথায়!
দেখিস তখন, কাণার জন্য আর
কষ্ট কিছু হয়না যেন তাঁর।
তার পরে---এই শেওলা-দীঘির ধার---
সঙ্গে আসতে বলবো নাক আর,
শেষের পথে কিসের বল' ভয়---
এইখানে এই বেতের বনের ধারে,
ডাহুক-ডাকা সন্ধ্যা-অন্ধকারে---
সবার সঙ্গে সাঙ্গ পরিচয়!
শেওলা-দীঘির শীতল অতল নীরে---
মায়ের কোলটি পাই যেন ভাই ফিরে'!
৩. ভালবাসার জয়
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
ও ভাই, ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে-
গোলাগুলির গোলাতে নয়, গভীর ভালবেসে।
খড়ুগ, সায়ক, শাণিত তরবার,
কতটুকুন সাধ্য তাহার, কি বা তাহার ধার?
শত্রুকে সে জিনতে পারে, কিনতে নারে যে সে-
ও তার স্বভাব সর্বনেশে।
ভালবাসায় ভুবন করে জয়,
সখ্যে তাহার অশ্রুজলে শত্রু মিত্র হয়-
সে যে সৃজন পরিচয়।
শত আঘাত-ব্যথা-অপমানে লয় সে কোলে এসে,
মৃত্যুরে সে বন্ধু বলে ধরে শেষে।
৪. যৌবন-চাঞ্চল্য
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
ভুটিয়া যুবতি চলে পথ;
আকাশ কালিমামাখা কুয়াশায় দিক ঢাকা।
চারিধারে কেবলই পর্বত;
যুবতী একেলা চলে পথ।
এদিক-ওদিক চায় গুনগুনি গান গায়,
কভু বা চমকি চায় ফিরে;
গতিতে ঝরে আনন্দ উথলে নৃত্যের ছন্দ
আঁকাবাঁকা গিরিপথ ঘিরে।
ভুটিয়া যুবতি চলে পথ।
টসটসে রসে ভরপুর--
আপেলের মত মুখ আপেলের মত বুক
পরিপূর্ণ প্রবল প্রচুর;
যৌবনের রসে ভরপুর।
মেঘ ডাকে কড়-কড় বুঝিবা আসিবে ঝড়,
একটু নাহিকো ডর তাতে;
উঘারি বুকের বাস, পুরায় বিচিত্র আশ
উরস পরশি নিজ হাতে!
অজানা ব্যাথায় সুমধুর--
সেথা বুঝি করে গুরুগুরু!
যুবতি একেলা পথ চলে;
পাশের পলাশ-বনে কেন চায় অকারণে?
আবেশে চরণ দুটি টলে--
পায়ে-পায়ে বাধিয়া উপলে!
আপনার মনে যায় আপনার মনে গায়,
তবু কেন আনপানে টান?
করিতে রসের সৃষ্টি চাই কি দশের দৃষ্টি?
--স্বরূপ জানেন ভগবান!
সহজে নাচিয়া যেবা চলে
একাকিনী ঘন বনতলে--
জানি নাকো তারো কী ব্যাথায়
আঁখিজলে কাজল ভিজায়!
৫. কাজলা দিদি
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;-
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন,
ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?
বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,
আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে।
ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল।
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,-
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!
বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে’
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই
রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
৬. দাসীপুত্র
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
পরের দুয়ারে দাসী বটে আজি, তবু সে মোদেরই মা,---
ভুলিবারে চাই সতত সে কথা ; ভুলিবারে পারি না।
কাঙালের ঘরে যাহা কিছু জোটে, সে যে ধূলিমাখা খুদ,
উপবাস ক্ষীণ শীর্ণ বক্ষে শুকায়ে গিয়াছে দুধ,---
তবু তাই খেয়ে বাঁচে এই প্রাণ, তাই দিয়ে এই দেহ,
ধূলামাটি মাখা তাহারই অঙ্কে বাঁধি দুদিনের গেহ,
হাঁটিতে শিখেছি যার হাঁটু ধরে, যে বুকে মেলিয়া পা,
হক ভিখারিনী---তবু সে জননী, কেমনে ভুলিব তা?
মাতা বিনতার দুখের দুলাল, মানুষ নয় সে, পাখি!
মায়ের দুঃখ-ভরা দাসীত্ব ঘুচাইয়াছিল না কি?
যতই এ-হিয়া উঠে গুমরিয়া বিপদ-বেদনা-বিষে,
মানুষের ঘরে জন্ম লভিয়া সে-কথা ভুলিব কিসে?
কোথা প্রাণপণ প্রবল নিষ্ঠা, চিত্ত অকুতোভয়,
কই সে বেদনা, শক্তিসাধনা, পণ মৃত্যুঞ্জয়?
প্রচণ্ড তেজ চাই সে গরুড়---আমাদেরই মাঝে চাই,
অমৃতের লাগি সেই প্রাণপণ--- ভুলিবনা ভুলি নাই।
এস তপস্বী, উগ্রশক্তি, এস হে কর্মবীর,
কর দৃঢ় পণ মায়ের চক্ষে মুছাতে অশ্রুনীর;
পায়ে-পায়ে যত বিভেদের বাধা ভুলায়ে পরস্পরে
ভায়ে ভায়ে আজি মিলাইতে হবে জননীর ভাঙা ঘরে;
এস হে হিন্দু, এস খ্রীষ্টীয়, পারসী, মুসলমান
যে মায়ের বুকে জন্ম তোমার, রাখ আজি তার মান।
যে জননী আজ ভিখারিনী হয়ে ভুলেছে আপন বাণী,
অর্জিয়া তারি ধর্মরাজ্য কর তাঁরে রাজরাণী।
৭. মাধবিকা
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
দখিন হাওয়া---রঙিন হাওয়া, নূতন রঙের ভাণ্ডারী,
জীবন-রসের রসিক বঁধু, যৌবনেরি কাণ্ডারী!
সিন্ধু থেকে সদ্দ বুঝি আসছ আজি স্নান করি'---
গাং-চিলেদের পক্ষধ্বনির শন্ শনানির গান্ ধরি';
মৌমাছিদের মনভুলানি গুনগুনানির সুর ধরে'---
চললে কোথায় মুগ্ধ পথিক, পথটি বেয়ে উত্তরে?
অনেক দিনের পরে দেখা, বছর-পারের সঙ্গী গো,
হোক্ না হাজার ছাড়াছাড়ি, রেখেছ সেই ভঙ্গি তো!
---তেমনি সরস ঠাণ্ডা পরশ, তেমনি গলার হাঁকটি , সেই
দেখতে পেলেই চিনতে পারি, কোনোখানেই ফাঁকটি নেই!
---কোথায় ছিলে বন্ধু আমার, কোন্ মলয়ের বন ঘিরে,'
নারিকেলের কুঞ্জে-বেড়া কোন্ সাগরের কোন্ তীরে!
লকলকে সেই বেতসবীথির বলো তো ভাই কোন্ গলি,
এলা-লতার কেয়াপাতার খবর তো সব মঙ্গলই?
---ভালো কথা, দেখলে পথে সবাই তোমায় বন্দে তো,---
বন্ধু বলে' চিনতে কারো হয়নি তো ভাই সন্দেহ?
নরনারী তোমার মোহে তেমনি তো সব ভুল করে---
তেমনিতর পরস্পরের মনের বনে ফুল ধরে!
আসতে যেতে দীঘির পথে তেমনি নারীর ছল করা;
পথিকবধুর চোখের কোণে তেমনি তো সেই জলভরা?
রঙ্গনে সেই রং তো আছে, অশোকে তাই ফুটছে তো,
শাখায় তারি দুলতে দোলায় তরুণীদল জুটছে তো?
তোমায় দেখে' তেমনি দেখে উঠছে তো সব বিহঙ্গ,
সবুজ ঘাসের শীষটি বেয়ে রয় তো চেয়ে পতঙ্গ?
তেমনি---সবই তেমনি আছে! --- হ'লাম শুনে' খুব খুশী,
প্রাণটা ওঠে চনচনিয়ে, মনটা ওঠে উসখুসি', ---
নূতন রসে রসল হৃদয়, রক্ত চলে চঞ্চলি', ---
বন্ধু তোমায় অর্ঘ্য দিলাম উচ্ছলিত অঞ্জলি।
গ্রহণ করো, গ্রহণ করো---বন্ধু আমার দণ্ডেকের---
জানিনাক আবার কবে দেখা তোমার সঙ্গে ফের।।
৮. দ্বিপ্রহরে
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
বইয়ের পাতায় মন বসেনা, খোলা পাতা খোলাই পড়ে’ থাকে,
চোখের পাতায় ঘুম আসেনা---- দেহের ক্লান্তি বুঝাই বলো কা’কে?
কাজের মাঝে হাত লাগাব, কোথাও কোন’ উত্সাহ নাই তার,
চেয়ে আছি চেয়েই আছি, চাওয়ার তবু নাইক কিছু আর !
বেলা বাড়ে, রোদ চড়ে’ যায়, প্রখর রবি দহে আকাশ তল,
ঝাঁঝাঁ করে ভিতর-বাহির, চোখের পথে শুকায় চোখের জল;
মোহাচ্ছন্ন মৌন জগৎ, কোথাও যেন জীবনচেষ্টা নাহি,
ক্লিষ্ট আকাশ নির্ণিমেষে দিনের দাহ দেখছে শুধু চাহি’!
ঘরে ঘরে আগল আঁটা, আমার ঘরেই মুক্ত শুধু দ্বার,
সেই যে খুলে’ চলে’ গেছে তেম্ নি আছে, কে দেয় উঠে’ আর !
পথের ধারে নিমের গাছে একটি কেবল তিক্ত মধুর শ্বাস
ক্ষণে ক্ষণে জানায় শুধু গোপন বুকের উদাসী উচ্ছ্বাস!
হাহা করে তপ্ত হাওয়া শষ্যহারা বসন্ত-শেষ মাঠে,
চোতের ফসল বিকিয়ে গেছে কবে কোথায় অজানা কোন্ হাটে!
উদার মলয় নিঃস্ব আজি, সাম্ নে শুধু ধূসর বালুচর
পঞ্চতপা দিক্-বিধবার বসন খানি লুট্ ছে নিরন্তর!
কোন্ পথে সে গেছে চলি’ মরু-বেলায় চিহ্নটি নাই তার,
লুপ্ত সকল শ্যামলিমা লয়ে তাহার মুগ্ধ উপাচার;
জাগ্ ছে শুধু প্রখর দাহ তৃষ্ণাভরা বিশুষ্ক জিহ্বায়
দিনান্ত সে আস্ বে কখন ? দম্ কা বাতাস ধমক্ দিয়ে যায়!
৯. কলঙ্ক
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
বাতাবিকুঞ্জে সন্ধ্যার বায় পুষ্পপরাগচোর------
কলঙ্কী মন, চেয়ে দেখ্ আজি সঙ্গী মিলেছে তোর।
দিবা অবসান, রবি হ’ল রাঙা,
পশ্চিমাকাশে নট্ কনা -ভাঙা;
সঙ্গহীনের যাহা কিছু কাজ সাঙ্গ করেছি মোর,
কুঞ্জদুয়ারে ব’সে আছি একা কুসুমগন্ধে ভোর!
আধফুটন্ত বাতাবিকুসুমে কানন ভরিয়া আছে,----
কি গোপন কথা গুঞ্জরি’ অলি ফিরিছে ফুলের কাছে!
ফুটনোন্মুখ ফুলদলগুলি
পুলক-পরশে উঠে দুলিদুলি
গন্ধভিখারী সন্ধ্যার বায় ফুলপরিমল যাচে-----
সঙ্কোচে নত পুষ্পবালিকা---অতিথি ফিরে বা পাছে!
বেলা বয়ে যায়, সন্ধ্যার বায় আসি’ কহে বার বার,
সন্ধ্যা হয় যে অন্ধ কুসুম-----খোলো অন্তর-দ্বার!
মুকুলগন্ধ অন্ধ ব্যথায়
কুঁড়ির বন্ধ টুটিবারে চায়,
লুটাইতে চায় সন্ধ্যার পায় রুদ্ধ আবেগভার,
বিকাইতে চায় চরণের পরে কৌমার সুকুমার।
মন্থরপদে সন্ধ্যা নামিছে কাজলতিমিরে আঁকা,
দুয়ারে অতিথি, অন্তরে ব্যথা--- সম্ভব সে কি থাকা?
গন্ধে পাগল অন্তর যার,
আবরণ মাঝে থাকে সে কি আর,
খুলি’ দিল দ্বার, পরান তাহার পরাগে-শিশিরে মাখা;
কুঞ্জ ঘিরিয়া আঁধারে ছাইল স্বপ্নপাখীর পাখা।
বাতাবিকুঞ্জে সন্ধ্যার বায় পুষ্পপরাগচোর----
হা রে কলঙ্কী হৃদয় আমার, সঙ্গী মিলেছে তোর।
দূরদিগন্তে দিবা হল সারা;
অন্তর ভরি ফুটে’ উঠে তারা,
নব-ফুটন্ত নেবুর গন্ধে আসিল তন্দ্রাঘোর-----
কলঙ্কী প্রেম, মুগ্ধ হৃদয়-----একই "পরিণাম তোর।
১০. কেয়াফুল
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
ফুল চাই ---- চাই কেয়াফুল!----
সহসা পথের ‘পরে
আমার এ ভাঙ্গা ঘরে
কন্ঠ কার ধ্বনিল আকুল।
তখনো শ্রাবণ-সন্ধ্যা
নিঃশেষে হয়নি বন্ধ্যা-----
থেকে থেকে ঝরিতেছে জল;
পবন উঠিছে জেগে,
বিজলী ঝলিছে বেগে------
মেঘে মেঘে বাজিছে মাদল।
জনহীন ক্ষুব্ধ পথ
জাগিছে দুঃস্বপ্নবৎ----
বুকে চাপি’ আর্ত্ত অন্ধকার;
কোনমতে কাজ সারি’
যে যার ফিরিছে বাড়ী,
ঘরে ঘরে বন্ধ যত দ্বার।
শূন্য ঘরে
হিয়া গুমরিয়া মরে
স্মরি’ যত জীবনের ভুল;
অকস্মাৎ তারি মাঝে
ধ্বনি কার কানে বাজে-----
চাই ফুল----চাই কেয়াফুল!
পাগল! আজি এ রাতে
এ দুর্য্যোগ-অভিঘাতে----
বৃষ্টিপাতে বিলুপ্ত মেদিনী;
তার মাঝে কে আছে,
কেতকী-সৌরভ যাচে!
কোথায় বা হবে বিকিকিনি?
পবন উঠিছে মাতি!
কিছুক্ষণ কান পাতি’
মনে হ’ল গিয়াছে বালাই;
সহসা আমারি দ্বারে
ডাক এল একেবারে----
চাই ফুল --- কেয়াফুল চাই!
ভাবিলাম মনে মনে-----
হয়ত বা এ জীবনে
কোনোদিন কিনেছিনু ফুল;
সেই কথা মনে ক’রে
আজো বা আশায় ঘোরে;
কিম্বা কারে করিয়াছে ভুল!
তাড়াতাড়ি আলো তুলি’
বাহিরিনু দ্বার খুলি,
সবিস্ময়ে দেখিলাম চেয়ে----
মাথায় বৃহৎ ডালা,
দাঁড়ায়ে পসারী-বালা-----
শ্রাবণ ঝরিছে অঙ্গ বেয়ে;
কহিলাম, এ কি কান্ড!
তোমার পসরাভান্ড
আজ রাতে কে কিনিবে আর ?
এ প্রলয়ে কারো কাছে
কিছু কি প্রত্যাশা আছে-----
কেন মিছে বহিছ এ ভার!
আর্দ্র দেহে আর্দ্র বাসে
সে কহিল মৃদু হাসে,-----
শিরে বায়ু সুগন্ধ ছড়ায়----
যে ফুল বেসাতি করি,
বাদল যে শিরে ধরি,-----
কপালে লিখিল বিধি তাই!
বহিয়া দুখের ঋণ
যে কষ্টে কাটাই দিন-----
এ দুর্দ্দিন কিবা তার কাছে?
ওগো তুমি নেবে কিছু?
নয়ন হইল নীচু----
সেথাও বা মেঘ নামিয়াছে!
খোলা দরজার পাশে
বায়ু গরজিয়া আসে,
ফুলবাসে ভরি দেহ-মন;
ঝর-ঝর ঝরে জল,
আঁখি করে ছল-ছল
ঘনাইয়া প্রাণের শ্রাবণ!
বাদলের বিহ্বলতা----
বুঝি হায়! লাগিল তা’
নয়নে বচনে সর্ব্ব দেহে;
সহসা চাহিয়া আড়
রমণী ফিরাল ঘাড়-----
উর্দ্ধে যেন কি দেখিবে চেয়ে!
না কহিয়া কোন বাণী
পসরা লইনু টানি’-----
মূল্য তার হাতে দিনু যবে,
উজার করিতে ডালা
কাঁদিয়া ফেলিল বালা------
ওমা এ কি ---- এত কেন হবে?
কহিনু ---যা’ কিনিলাম,
এ নহে তাহারি দাম-----
প্রতিদিন দিতে হবে মোরে;
এক পণ দুই পণ----
যেদিন যেমন মন,
তাহারি আগাম দিনু তোরে;
কতক বুঝে’ না-বুঝে’
হৃদয়ের ভাষা খুঁজে’
বহুকষ্টে জানাইয়া তাই,
পুষ্পগন্ধে মোরে ঘিরে’
অন্ধকারে ধীরে-ধীরে
পসারিনী লইল বিদায়।
ফিরিনু একলা ঘরে-----
বাদল তখনো ঝরে,
পুষ্পগন্ধে পূর্ণ গৃহতল;
শয্যা লইলাম পাতি’
নিবায়ে দিলাম বাতি----
আবার আসিল বেগে জল!
রুদ্ধ জানালার ফাঁকে
বাতাস কাহারে ডাকে,
বিজলী চমকি’ কারে চায়!
কোন্ অন্ধ অনুরাগে
ত্রিযামা যামিনী জাগে
শ্রাবণ ব্যাকুল-ব্যর্থতায়!
সঙ্গীহীন শূন্য ঘরে
হিয়া গুমরিয়া মরে----
স্মরিয়া এ জীবনের ভুল;
সেই সাথে থেকে- থেকে
মনে হয় --- গেল ডেকে’
কাননের যত কেয়াফুল!
১১. কর্ম
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
শক্তি মায়ের ভৃত্য মোরা- নিত্য খাটি নিত্য খাই,
শক্ত বাহু, শক্ত চরণ, চিত্তে সাহস সর্বদাই।
ক্ষুদ্র হউক, তুচ্ছ হউক, সর্ব সরম-শঙ্কাহীন---
কর্ম মোদের ধর্ম বলি কর্ম করি রাত্রি দিন।
চৌদ্দ পুরুষ নিঃস্ব মোদের - বিন্দু তাহে লজ্জা নাই,
কর্ম মোদের রক্ষা করে অর্ঘ্য সঁপি কর্মে তাই।
সাধ্য যেমন - শক্তি যেমন - তেমনি অটল চেষ্টাতে--
দুঃখে-সুখে হাস্যমুখে কর্ম করি নিষ্ঠাতে।
কর্মে ক্ষুধার অন্ন যোগায়, কর্মে দেহে স্বাস্থ্য পাই;
দুর্ভাবনায় শান্তি আনে --- নির্ভাবনায় নিদ্রা যাই।
তুচ্ছ পরচর্চাগ্লানি--- মন্দ ভালো--- কোন্ টা কে---
নিন্দা হতে মুক্তি দিয়া হাল্কা রেখে মনটাকে।
পৃথ্বি-মাতার পুত্র মোরা, মৃত্তিকা তার শয্যা তাই;
পুষ্পে-তৃণে বাসটি ছাওয়া, দীপ্তি-হাওয়া ভগ্নী-ভাই।
তৃপ্তি তাঁরি শস্যে-জলে ক্ষুত্ পিপাসা দুঃসহ।
মুক্ত মাঠে যুক্ত করে বন্দি তাঁরেই প্রত্যহ।
ক্ষুদ্র নহি - তুচ্ছ নহি - ব্যর্থ মোরা নই কভু।
অর্থ মোদের দাস্য করে - অর্থ মোদের নয় প্রভু।
স্বর্ণ বল, রৌপ্য বল, বিত্তে করি জন্মদান,
চিত্ত তবু রিক্ত মোদের নিত্য রহে শক্তিমান।
কীর্তি মোদের মৃত্তিকাতে প্রত্যহ রয় মুদ্রিত,
শুণ্য' পরে নিত্য হের স্তোত্র মোদের উদ্গীত।
সিন্ধুবারি পণ্য বহি' ধন্য করে তৃপ্তিতে,
বহ্নি' মোদের রুদ্র প্রতাপ ব্যক্ত করে দীপ্তিতে।
বিশ্ব জুড়ি' সৃষ্টি মোদের, হস্ত মোদের বিশ্বময়,
কাণ্ড মোদের, সর্বঘটে - কোন্ খানে তা দৃষ্য নয়?
বিশ্বনাথের যজ্ঞশালে কর্মযোগের অন্ত নাই,
কর্ম সে যে ধর্ম মোদের, -- কর্ম চাহি -- কর্ম চাই।
আমাদের এই কবিতা গুলো কষ্ট করে পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।আমার লেখার ভিতর অনেক কোনো ভুল হয়ে থাকে, প্লিজ আমাকে ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।
পরবর্তী পর্বের পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।
No comments