কাজী নজরুল ইসলাম এর কবিতা-সমূহ - TECHNICAL BANGLA

কাজী নজরুল ইসলাম এর কবিতা-সমূহ

হ্যালো বন্ধুরা,
কবিতা পর্ব-৩: এ আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।কাজী নজরুল হলেন বিদ্রোহী কবি।তার লেখা কবিতা গুলো অসাধারন।আমি আজকে নিয়ে আসলাম কবি  কাজী নজরুল ইসলাম লেখা ১০টি কবিতা।
          
দুখু মিয়া

      
pomes



চলুন দেখে আসি কবিতা গুলো:-



১.                         সাম্যবাদী
                  কাজী নজরুল ইসলাম

গাহি সাম্যের গান-
 যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
 যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান।
 গাহি সাম্যের গান!
 কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
 কন্ফুসিয়াস্? চার্বআখ চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
 বন্ধু, যা-খুশি হও,
 পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
 কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
 জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব প’ড়ে যাও, যত সখ-
 কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
 দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল!
 তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
 সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা, খুলে দেখ নিজ প্রাণ!
 তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম, সকল যুগাবতার,
 তোমার হৃষয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার।
 কেন খুঁজে ফের’ দেবতা ঠাকুর মৃত পুঁথি -কঙ্কালে?
 হাসিছেন তিনি অমৃত-হিয়ার নিভৃত অন্তরালে!

 বন্ধু, বলিনি ঝুট,
 এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট।
 এই হৃদ্য়ই সে নীলাচল, কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন,
 বুদ্ধ-গয়া এ, জেরুজালেম্ এ, মদিনা, কাবা-ভবন,
 মস্জিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
 এইখানে ব’সে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
 এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা,
 এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা।
 এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা-মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
 ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি’।
 এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহবান,
 এইখানে বসি’ গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান!
 মিথ্যা শুনিনি ভাই,
 এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।

২.                     মুনাজাত
         কবি কাজী নজরুল ইসলাম

আমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে
বাঁচাও প্রভু উদার।
হে প্রভু! শেখাও -নীচতার চেয়ে
নীচ পাপ নাহি আর।

 যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী,
যুগ-যুগান্ত নরকেও যাপি,
জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা-
ক্ষমা নাহি নীচতার।।

 ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমার
হৃদয়ের পরিসর,
যেন সম ঠাঁই পায়
শত্রু-মিত্র-পর।

 নিন্দা না করি ঈর্ষায় কারো
অন্যের সুখে সুখ পাই আরো,
কাঁদি তারি তরে অশেষ দুঃখী
ক্ষুদ্র আত্মা তার।।

৩.                  পথহারা
        কবি কাজী নজরুল ইসলাম


বেলা শেষে উদাস পথিক ভাবে,
সে যেন কোন অনেক দূরে যাবে –
উদাস পথিক ভাবে।

  ‘ঘরে এস’ সন্ধ্যা সবায় ডাকে,
‘নয় তোরে নয়’ বলে একা তাকে;
পথের পথিক পথেই বসে থাকে,
জানে না সে কে তাহারে চাবে।
উদাস পথিক ভাবে।

 বনের ছায়া গভীর ভালোবেসে
আঁধার মাথায় দিগবধূদের কেশে,
ডাকতে বুঝি শ্যামল মেঘের দেশে
শৈলমূলে শৈলবালা নাবে –
উদাস পথিক ভাবে।

 বাতি আনি রাতি আনার প্রীতি,
বধূর বুকে গোপন সুখের ভীতি,
বিজন ঘরে এখন সে গায় গীতি,
একলা থাকার গানখানি সে গাবে-
উদাস পথিক ভাবে।

 হঠাৎ তাহার পথের রেখা হারায়
গহন বাঁধায় আঁধার-বাঁধা কারায়,
পথ-চাওয়া তার কাঁদে তারায় তারায়
আর কি পূবের পথের দেখা পাবে
উদাস পথিক ভাবে।

৪.                 বিদ্রোহী
            কাজী নজরুল ইসলাম

বল বীর –
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর –
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর –
আমি চির উন্নত শির!

 আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর –
চির-উন্নত মম শির!

 আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দিই তিন দোল;
আমি চপলা-চপল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা!
আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর!
বল বীর
আমি চির উন্নত শির!

 আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ,
আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।

 আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য;
আমি কৃষ্ন-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধীর।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর
চির উন্নত মম শির!

 আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার,
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস, আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস!
আমি কভূ প্রশান্ত কভূ অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভোন্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহা কল্লোল,
আমি উদ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্জ্বল,
আমি উচ্ছ্বল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!

 আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণু, তন্বী-নয়নে বহ্ণি
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বন্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, প্রিয় লান্চিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়
চিত চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-করে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন-কন!
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচড় কাঁচলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!

 আমি উথ্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!

 আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নিয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্ণি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সন্চারি ভুবনে সহসা সন্চারি ভূমিকম্প।

 ধরি বাসুকির ফণা জাপটি
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’।
আমি দেব শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব মায়ের অন্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম
ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠি যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!

 আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!

 আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!

 আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে
আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।

 আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!

 আমি চির-বিদ্রোহী বীর
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!


৫.                      মানুষ 
              কাজী নজরুল ইসলাম


গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান,
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সল কালে, ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
‘পূজারী, দুয়ার খোল,
ক্ষুদার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!’
স্বপ্ন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ’য়ে যাবে নিশ্চয়!
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুদায় কন্ঠ ক্ষীণ
ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোল বাবা, খাইনি তো সাত দিন!’
সহসা বন্ধ হ’ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,
তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুদার মানিক জ্বলে!
ভুখারী ফুকারি’ কয়,
‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’

 মসজিদে কাল শিরনী আছিল, অঢেল গোস্ত রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি!
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে-আজারির চিন্
বলে ‘বাবা, আমি ভুকা ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!’
তেরিয়াঁ হইয়া হাঁকিল মোল্লা – ভ্যালা হ’ল দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?
ভুখারী কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল – তা’ হলে শালা
সোজা পথ দেখ!’ গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা!
ভুখারী ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে-
আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুদার অন্ন তা’বলে বন্ধ করোনি প্রভু
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!

৬.                  লিচু চোর
             কাজী নজরুল  ইসলাম

বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সে কি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।

 পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,

 ও বাবা মড়াত করে
পড়েছি সরাত জোরে।
পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,
সে ছিল গাছের আড়েই।
ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,
ধুমাধুম গোটা দুচ্চার
দিলে খুব কিল ও ঘুষি
একদম জোরসে ঠুসি।

 আমিও বাগিয়ে থাপড়
দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়
লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,
দেখি এক ভিটরে শেয়াল!
ও বাবা শেয়াল কোথা
ভেলোটা দাড়িয়ে হোথা
দেখে যেই আঁতকে ওঠা
কুকুরও জাড়লে ছোটা!
আমি কই কম্ম কাবার
কুকুরেই করবে সাবাড়!

  ‘বাবা গো মা গো’ বলে
পাঁচিলের ফোঁকল গলে
ঢুকি গিয়ে বোসদের ঘরে,
যেন প্রাণ আসলো ধড়ে!

 যাব ফের? কান মলি ভাই,
চুরিতে আর যদি যাই!
তবে মোর নামই মিছা!
কুকুরের চামড়া খিঁচা
সেকি ভাই যায় রে ভুলা-
মালীর ঐ পিটুনিগুলা!
কি বলিস ফের হপ্তা!
তৌবা-নাক খপ্তা…!

৭.                  সংকল্প
            কাজী নজরুল ইসলাম

থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,-
 কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।
 দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
 ছুটছে তারা কেমন করে,
 কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,
 কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ-যন্ত্রণারে।।

 কেমন করে বীর ডুবুরী সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে,
 কেমন করে দুঃসাহসী চলছে উড়ে স্বরগ পানে।
 জাপটে ধরে ঢেউয়ের ঝুঁটি
 যুদ্ধ-জাহাজ চলছে ছুটি,
 কেমন করে আঞ্ছে মানিক বোঝাই করে সিন্ধু-যানে,
 কেমন জোরে টানলেসাগর উথলে ওঠে জোয়ার বানে।

 কেমন করে মথলে পাথার লক্ষী ওঠেন পাতাল ফুঁড়ে,
 কিসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালয় চুড়ে।
 তুহিন মেরু পার হয়ে যায়
 সন্ধানীরা কিসের আশায়;
 হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরেঃ
 শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন 'মঙ্গল' হতে আসছে উড়ে।।

 কোন বেদনার টিকিট কেটে চন্ডু-খোর এ চীনের জাতি
 এমন করে উদয়-বেলায় মরণ-খেলায় ওঠল মাতি।
 আয়ার্ল্যান্ড আজ কেমন করে
 স্বাধীন হতে চলছে ওরেঃ
 তুরষ্ক ভাই কেমন করে কাঁটল শিকল রাতারাতি!
 কেমন করে মাঝ গগনে নিবল গ্রীসের সূর্য-বাতি।।

 রইব না কো বদ্ধ খাঁচায়, দেখব এ-সব ভুবন ঘুরে-
 আকাশ বাতাস চন্দ্র-তারায় সাগর-জলে পাহাড়-চুঁড়ে।
 আমার সীমার বাঁধন টুটে
 দশ দিকেতে পড়ব লুটেঃ
 পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়েঃ
 বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।।
৮.          খুকি ও কাঠবেড়ালি
            কাজী নজরুল ইসলাম

কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?
 গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি-নেবু? লাউ?
 বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও-
 ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,
 খাও একা পাও যেথায় যেটুক!
 বাতাবি-নেবু সকলগুলো
 একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
 তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?
 ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!

 কাঠবেড়ালি! বাঁদরীমুখী! মারবো ছুঁড়ে কিল?
 দেখবি তবে? রাঙাদাকে ডাকবো? দেবে ঢিল!
 পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা!
 তাই তোর নাকটি বোঁচা!
 হুতমো-চোখী! গাপুস গুপুস
 একলাই খাও হাপুস হুপুস!
 পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে!
 হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!
 ইস! খেয়ো না মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও!
 আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও!

 কাঠবেড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি' হবে? বৌদি হবে? হুঁ!
 রাঙা দিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঃ!
 এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো?
 ফ্রকটা নেবে? জামা দুটো?
 আর খেয়ো না পেয়ার তবে,
 বাতাবি-নেবুও ছাড়তে হবে!
 দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ ছুট? অ'মা দেখে যাও!-
 কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!!

৯.               শিশু যাদুকর 
            কাজী নজরুল ইসলাম

পার হয়ে কত নদী কত সে সাগর
 এই পারে এলি তুই শিশু যাদুকর!
 কোন রূপ-লোকে ছিলি রূপকথা তুই,
 রূপ ধরে এলি এই মমতার ভুঁই।

 নবনীতে সুকোমল লাবণি লয়ে
 এলি কে রে অবনীতে দিগ্বিজয়ে।
 কত সে তিমির-নদী পারায়ে এলি-
 নির্মল নভে তুই চাঁদ পহেলি।

 আমরার প্রজাপতি অন্যমনে
 উড়ে এলি দূর কান্তার-কাননে।
 পাখা ভরা মাখা তোর ফুল-ধরা ফাঁদ,
 ঠোঁটে আলো চোখে কালো-কলঙ্কী চাঁদ!
 কালো দিয়ে করি তোর আলো উজ্জ্বল-
 কপালেতে টিপ দিয়ে নয়নে কাজল।

 তারা-যুঁই এই ভুঁই আসিলি যবে,
 একটি তারা কি কম পড়িল নভে?
 বনে কি পড়িল কম একটি কুসুম?
 ধরণীর কোলে এলি একরাশ চুম।

 স্বরগের সব-কিছু চুরি করে, চোর,
 পলাইয়া এলি এই পৃথিবীর ক্রোড়!
 তোর নামে রহিল রে মোর স্মৃতিটুক,
 তোর মাঝে রহিলাম আমি জাগরুক।

১০.                 মা
         কাজী নজরুল  ইসলাম


যেখানেতে দেখি যাহা
 মা-এর মতন আহা
 একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
 মায়ের মতন এত
 আদর সোহাগ সে তো
 আর কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!

 হেরিলে মায়ের মুখ
 দূরে যায় সব দুখ,
 মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
 মায়ের শীতল কোলে
 সকল যাতনা ভোলে
 কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।

 কত করি উৎপাত
 আবদার দিন রাত,
 সব স’ন হাসি মুখে, ওরে সে যে মা!
 আমাদের মুখ চেয়ে
 নিজে র’ন নাহি খেয়ে,
 শত দোষী তবু মা তো তাজে না।

 ছিনু খোকা এতটুকু,
 একটুতে ছোট বুক
 যখন ভাঙিয়া যেতো, মা-ই সে তখন
 বুকে করে নিশিদিন
 আরাম-বিরাম-হীন
 দোলা দেয় শুধাতেন, ‘কি হোলো খোকন?’

 আহা সে কতই রাতি
 শিয়রে জ্বালায়ে বাতি
 একটু আসুখ হলে জাগেন মাতা,
 সব-কিছু ভুলে গিয়ে
 কেবল আমায়ের নিয়ে
 কত আকুলতা যেন জাগন্মাতা।

 যখন জন্ম নিনু
 কত আসহায় ছিনু,
 কাঁদা ছাড়া নাহি জানিতাম কোন কিছু,
 ওঠা বসা দূরে থাক-
 মুখে নাহি ছিল বাক,
 চাহনি ফিরিত শুধু আর পিছু পিছু।

 তখন সে মা আমার
 চুমু খেয়ে বারবার
 চাপিতেন বুকে, শুধু একটি চাওয়ায়
 বুঝিয়া নিতেন যত
 আমার কি ব্যথা হোতো,
 বল কে ওমন স্নেহে বুকটি ছাওয়ায়।

 তারপর কত দুখে
 আমারে ধরিয়া বুকে
 করিয়া তুলেছে মাতা দেখো কত বড়,
 কত না সে সুন্দর
 এ দেহে এ অন্তর
 সব মোর ভাই বোন হেথা যত পড়।

 পাঠশালা হ’তে যবে
 ঘরে ফিরি যাব সবে,
 কত না আদরে কোলে তুলি’ নেবে মাতা,
 খাবার ধরিয়া মুখে
 শুধাবেন কত সুখে
 কত আজ লেখা হোলো, পড়া কত পাতা?’

 পড়া লেখা ভাল হ’লে
 দেখেছ সে কত ছলে
 ঘরে ঘরে মা আমার কত নাম করে।
 বলে, ‘মোর খোকামনি!
 হীরা-মানিকের খনি,
 এমনটি নাই কারো!’ শুনে বুক ভরে।

 গা’টি গরম হলে
 মা সে চোখের জলে
 ভেসে বলে, ‘ওরে যাদু কি হয়েছে বল’।
 কত দেবতার ‘থানে’
 পীরে মা মানত মানে-
 মাতা ছাড়া নাই কারো চোখে এত জল।

 যখন ঘুমায়ে থাকি
 জাগে রে কাহার আঁখি
 আমার শিয়রে, আহা কিসে হবে ঘুম।
 তাই কত ছড়া গানে
 ঘুম-পাড়ানীরে আনে,
 বলে, ‘ঘুম! দিয়ে যা রে খুকু-চোখে চুম’।

 দিবানিশি ভাবনা
 কিসে ক্লেশ পাব না,
 কিসে সে মানুষ হব, বড় হব কিসে;
 বুক ভ’রে ওঠে মা’র
 ছেলেরি গরবে তাঁর,
 সব দুখ হয় মায়ের আশিসে।

 আয় তবে ভাই বোন,
 আয় সবে আয় শোন
 গাই গান, পদধূলি শিরে লয়ে মা’র;
 মা’র বড় কেহ নাই-
 কেউ নাই কেউ নাই!
 নত করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!’


আজকের পর্ব এই এখানে শেষ করলাম,,, আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।। 

No comments

Theme images by diane555. Powered by Blogger.