কবি জসীমউদ্দীন এর কবিতা-সমূহ - TECHNICAL BANGLA

কবি জসীমউদ্দীন এর কবিতা-সমূহ

 হ্যালো বন্ধুরা।Technical Bangla পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।
  কবিতা পর্ব-২: আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।আমি আজকে নিয়ে আসলাম কবি জসীমউদ্দীন লেখা ১২টি কবিতা।যা আপনাদের রূদয়ে নাড়া দিতে পারে।


কবিতা গুলো সবাই মনযোগ দিয়ে পড়বেন।চলুন দেখে আসি কবিতা গুলো- 


১.     এত হাসি কোথায় পেলে

                    জসীমউদ্দীন

         এত হাসি কোথায় পেলে 
         এত কথার খলখলানি 
          কে দিয়েছে মুখটি ভরে 
        কোন বা গাঙের কলকলানি। 
        কে দিয়েছে রঙিন ঠোঁটে 
        কলমী ফুলের গুলগুলানি। 
        কে দিয়েছে চলন বলন 
        কোন সে লতার দোল দুলানী। 

       কাদের ঘরে রঙিন পুতুল 
         আদরে যে টইটুবানি। 
         কে এনেছে বরণ ডালায় 
          পাটের বনের বউটুবানী। 
          কাদের পাড়ার ঝামুর ঝুমুর 
         কাদের আদর গড়গড়ানি 
         কাদের দেশের কোন সে চাঁদের 
         জোছনা ফিনিক ফুল ছড়ানি। 

        তোমায় আদর করতে আমার 
          মন যে হলো উড়উড়ানি 
           উড়ে গেলাম সুরে পেলাম 
           ছড়ার গড়ার গড়গড়ানি।


২.                  আসমানী
                   জসীমউদ্দীন

আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, 
 রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। 
 বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি, 
 একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি। 
 একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে, 
 তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে। 
 পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক-খান হাড়, 
 সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার। 
 মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি 
 থাপড়েতে নিবিয়ে দেছে দারুণ অভাব আসি। 
 পরনে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস, 
 সোনালি তার গা বরণের করছে উপহাস। 
 ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি, 
 সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি। 
 বাঁশির মতো সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে, 
 হয় নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে। 
 আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে 
 ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল্-বিল্-বিল করে। 
 ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে, 
 সেই জলেতে রান্না-খাওয়া আসমানীদের চলে। 
 পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার, 
 বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।


৩.                   আলাপ
                   জসীমউদ্দীন


ঘুমপাড়ানী ঘুমের দেশে ঘুমিয়ে দুটি আঁখি, 
 মুখেতে তার কে দিয়েছে চাঁদের হাসি মাখি। 
 পা মেজেছে চাঁদের চুমোয়, হাতের ঘুঠোয় চাঁদ, 
 ঠোঁট দুটিতে হাসির নদীর ভাঙবে বুঝি বাঁধ। 
 মাথায় কালো চুলের লহর পড়ছে এসে মুখে, 
 ঝাঁকে ঝাঁকে ভোমর যেন উড়ছে ফুলের বুকে। 

 এই খুকীটির সঙ্গে আমার আলাপ যদি হয়, 
 সাগর-পারের ঝিনুক হয়ে ভাসব সাগরময় 
 রঙিন পাখির পালক হয়ে ঝরব বালুর চরে, 
 শঙ্খমোতির মালা হয়ে দুলব টেউএর পরে। 
 তবে আমি ছড়ার সুরে ছড়িয়ে যাব বায়, 
 তবে আমি মালা হয়ে জড়াব তার গায়। 

 এই খুকীটি আমায় যদি একটু আদর করে, 
 একটি ছোট কথা শোনায় ভালবাসায় ভরে 
 তবে আমি বেগুন গাছে টুনটুনীদের ঘরে, 
 যত নাচন ছড়িয়ে আছে আনব হরণ করে 
 তবে আমি রুপকথারি রুপের নদী দিয়ে, 
 চলে যাব সাত-সাগরে রতন মানিক নিয়ে 
 তবে আমি আদর হয়ে জড়াব্ তার গায়, 
 নুপুর হয়ে ঝুমুর ঝুমুর বাজব দুটি পায়।


৪.              পুতুল
              জসীমউদ্দীন

পুতুল, তুমি পুতুল ওগো ! কাদের খেলা-ঘরের ছোট খুকু, 
 কাদের ঘরের ময়না পাখি ! সোহাগ-করা কাদের আদরটুকু। 
 কার আঁচলের মানিক তুমি। কার চোখেতে কাজললতা হয়ে, 
 এসেছ এই সোনার দেশে রামধনুকের রঙের হাসি লয়ে। 
 ভোর বেলাকার শিশির তুমি, কে রেখেছে শিউলী ফুলের পরে, 
 খোকা-ভোরের হাসিখানি কে রেকেছে পদ্মপাতায় ধরে। 

 পুতুল! তুমি মাটির পুতুল! নানাজনের স্নেহের অত্যাচার, 
 হাসিমুখে সইতে পার আপন পরের তাই ধার না ধার। 
 তাই ত তুমি পুতুল লয়ে সারাটা দিন খেলাও খেলাঘরে, 
 তুমি পুতুল, তাই ত পুতুল খেলার সাথী তোমার স্নেহের বরে। 

 পুতুল! আমার সোনার পুতুল! আমি পুতুল হব তোমার বরে, 
 তুমি হবে আমার পুতুল সারাটা দিন কাটবে আদর করে। 
 তোমায় আমি চাঁদ বলিব, জোছনা দিয়ে মুছিয়ে দিও মুখ, 
 তোমায় আমি বলব মানিক, মালা হয়ে জুড়িয়ে দিও বুক। 
 তুমি আমার উদয়-তারা, হাতে পায়ে জ্বলবে সোনার ফুল, 
 তুমি আমার রূপের সাগর রূপকথা যার খুঁজে না পায় কূল। 
 আমি তোমার কি হব ভাই? পুতুল! আমার রাঙা পুতুল-খুকু, 
 ঘুমপাড়ানী মাসী-পিসীর ঘুমের দেশের ঘুমানীটুকু।
           

৫.  বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়েছে  

                  জসীমউদ্দীন

বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়েছে 
 বালুর চরে, 
 কেমনে ফিরিব গোধন লইয়া 
 গাঁয়ের ঘরে। 

 কোমল তৃণের পরশ লাগিয়া, 
 পায়ের নুপুর পড়িয়াছে খসিয়া। 
 চলিতে চরণ ওঠে না বাজিয়া 
 তেমন করে। 

 কোথায় খেলার সাথীরা আমার 
 কোথায় ধেনু, 
 সাঝেঁর হিয়ায় রাঙিয়া উঠিছে 
 গোখুর-রেণু। 

 ফোটা সরিষার পাঁপড়ির ভরে 
 চরো মাঠখানি কাঁপে থরে থরে। 
 সাঁঝের শিশির দুচরণ ধরে 
 কাঁদিয়া ঝরে। 


৬.                রাতের পরী
                  জসীমউদ্দীন


রাতের বেলায় আসে যে রাতের পরী, 
 রজনীগন্ধা ফুলের গন্ধে সকল বাতাস ভরি। 
 চরণের ঘায়ে রাতের প্রদীপ নিভিয়া নিভিয়া যায়, 
 হাসপাতালের ঘর ভরিয়াছে চাঁদিমার জোছনায়। 

 মানস সরের তীর হতে যেন ধবল বলাকা আসে, 
 ধবল পাখায় ঘুম ভরে আনে ধবল ফুলের বাসে। 
 নয়ন ভরিয়া আনে সে মদিরা, সুদূর সাগর পারে, 
 ধবল দ্বীপের বালু-বেলাতটে শঙ্খ ছড়ায় ভারে। 
 তাহাদেরি সাথে লক্ষ বছর ঘুমাইয়া নিরালায়, 
 ধবল বালুর স্বপন আনিয়া মাখিয়াছে সারা গায়। 
 আজ ঘুম ভেঙে আসিয়াছে হেথা, দেহ লাবনীর পরে, 
 কত না কামনা ডুবিছে ভাসিছে আপন খুশীর ভরে। 
 বসনে তাহার একে একে আসি আকাশের তারাগুলি, 
 জ্বলিছে নিবিছে আপনার মনে রাতের বাতাসে দুলি। 

 রাতের বেলায় আসে যে রাতের পরী 
 চরণে বাজিছে ঝিঁঝির নূপুর দোলে ধরা মরি মরি! 
 তাহারি দোলায় বনপথে পথে ফুটিছে জোনাকী ফুল, 
 রাত-জাগা পাখি রহিয়া রহিয়া ছড়ায় গানের ভুল! 
 তারি তালে তালে স্বপনের পরী ঘুমের দুয়ার খুলে, 
 রামধনু রাঙা সোনা দেশেতে ডেকে যায় হাত তুলে। 
 হলুদ মেঘের দোলায় দুলিয়া হলদে রাজার মেয়ে, 
 তার পাছে পাছে হলুদ ছড়ায়ে চলে যায় গান গেয়ে। 

 রাতের বেলায় ঝুমিছে রাতের পরী, 
 মোহ মদিরার জড়াইছে ঘুম সোনার অঙ্গ ভরি। 
 চেয়ারের গায়ে এলাইল দেহ খানিক শ্রানি-ভরে, 
 কেশের ছায়ায় মায়া ঘনায়েছে অধর লাবনী পরে। 
 যেন লুবানের ধূঁয়ার আড়ালে মোমের বাতির রেখা, 
 কবরের পামে জ্বালাইয়া কেবা রচিতেছে কোন লেখা। 
 পাশে মুমূর্ষু রোগীর প্রদীপ নিবু নিবু হয়ে আসে, 
 উতল বাতাস ঘুরিয়া ফিরিয়া কাঁদিছে দ্বারের পাশে। 
 মরণের দূত আসিতে আসিতে থমকিয়া থেমে যায়, 
 শিথিল হস্ত হতে তরবারি লুটায় পথের গায়। 
 যুক্ত করেতে রচি অঞ্জলি বার বার ক্ষমা মাগে, 
 রাত্রের পরী মেলি দেহভার ঝিমায় ঘুমের রাগে। 

 ভোরের শিশির পদ্ম পাতায় রচিয়া শীতল চুম, 
 তাহার দুইটি নয়ন হইতে মুছাইয়া দিবে ঘুম। 
 রক্তোৎপল হইতে সিদুর মানাইতে তার ঠোঁটে, 
 শুক-তারকার সোনার তরনী দীঘির জলে যে লোটে।


৭.                  বৈদেশী বন্ধু
                    জসীমউদ্দীন


গান-বারমাসির সুর 
 যাওরে বৈদেশী বন্ধু যাও হাপন ঘরে, 
 অভাগী অবলার কথা রাইখ মনে করে। 
 তোমার দেশেতে বন্ধু। ফুটবে কদম কলি, 
 আমার দেশে কাজল্যা মেঘা নামবে ঢলি ঢলি। 
 সেই না কাজলা মেঘা ঝরে রয়া রয়া, 
 বিজলীর আগুন তাতে পড়ে খয়া খয়া। 
 সেই আগুন-লাগিবো আমার বুকের বসনে, 
 সেই আগুন লাগিবো আমার বে-ঘুম শয়নে। 

 আপন দেশে যাওরে বন্ধু। আপনার ঘর, 
 দেখিবা আপন জন পরবাস-অন্তর। 
 মায়েতে মুছাবে মুখ বুকের বসন দিয়া, 
 বইনে ত করবো বাতাস আবের পাঙ্খা দিয়া। 
 মায়ে না বসায়া তোমায় কোলের উপর, 
 নিরালে জিগাইব কত পরবাসের খবর। 
 মায়ের না আগেরে বন্ধু, বইনের না আগে, 
 কইও এ অভাগীর কথা যদি মনে লাগে। 

 মা বুনের আদরে বন্ধু থাকবা যখন ঘরে 
 অভাগী অবলার কথা দেইখ মনে করে। 
 ভাবিও তোমার মায়ে যে যত্তন করে, 
 তেমনি যত্তন কান্দে বৈদেশ নগরে। 
 হাপনার ভাইএ বইনে যে আদর করে, 
 তেমনি আদর আছে বেগানারও ঘরে। 
 ঘরেতে আছে তোমার ধর্ম সোদ্দের বোন, 
 তোমার উপর দাবী তাহার জানে সর্বজন। 
 মায়েরও আছে দাবী, বুকের দুধ দিয়া, 
 তোমারে মানুষ করল কত না করিয়া। 
 আমি যে বেগানা নারী কোন দাবী নাই, 
 সেই দুঃখে মরিরে, বন্ধু !কুল নাহি পাই। 

 বৈদেশী পৈড়াত !তুমি টাকায় খাটো জন, 
 তারে আজ কি দাম দিলা যার নিলা মন। 
 আমার দেশে ধান কাটিতে মন কাটিয়া গেলে, 
 ধানের দামই নিয়ে গেলে মনের দামটা ফেলে। 
 সেই না ধানের খেতে আবার ঐব ধান, 
 শাঙইনা পনিতে ভাসপো কাজইলা আসমান 
 আমার মনেতে বন্ধু। শুধুই চত্রিক মাস, 
 দুপুইয়া আসমান ছাড়ে আগুনীর শ্বাস। 
 সেই না আসমানের তলে বাজ ডাকে রয়া, 
 কেমন গোঁয়াইব কাল মোরে যাও কয়া।

৮.           জলের কন্যা
               জসীমউদ্দীন


জলের উপরে চলেছে জলের মেয়ে, 
 ভাঙিয়া টুটিয়া আছড়িয়া পড়ে ঢেউগুলি তটে যেয়ে। 
 জলের রঙের শাড়ীতে তাহার জড়ায়ে জড়ায়ে ঘুরি, 
 মাতাল বাতাস অঙ্গের ঘ্রাণ ফিরিছে করিয়া চুরি। 
 কাজলে মেখেছে নতুন চরের সবুজ ধানের কায়া, 
 নয়নে ভরেছে ফটিকজলের গহন গভীর মায়া। 
 তাহার উপর ছায়া-চুরি খেলা করিতে তটের বন, 
 সুবাস ফুলের গন্ধ ছড়ায়ে হাসিতেছে সারাখন। 

 জলের কন্যা চলেছে জলের রথে, 
 খুশীতে ফুটিয়া শাপলা-পদ্ম হাসিতেছে পথে পথে। 
 আগে আগে চলে কলজলধারা ভাসায়ে পানার তরী, 
 চরণে তাহার আলতা পরাতে হিজল পড়িছে ঝরি। 
 ডাহুক ডাহুকী ডাকে বন-পথে নতুন পানির সুরে, 
 কোঁড়া আজ তার কুঁড়ীরে খুঁজিছে ঘন পাট-ক্ষেতে দূরে; 
 পুরাতন জালে তালি দিতে দিতে ঢলিয়া জেলের গায়, 
 জেলে বোর মন মিহিসুরী গানে উজানীর বাঁকে ধায়। 
 পল্লীবধূরা উদাস নয়নে চেয়ে থাকে তটপানে, 
 বাপের বাড়ির মমতায় আজ পরাণ কেন যে টানে। 
 বাঙড়ের খালে সিনান করিতে কলসী ধরিয়া টানি, 
 মায়েরে কহিছে মেয়ের কথাটি নয়া-জোয়ারের পানি! 

 হোগরার ছই নতুন বাঁধিয়া গাব-জলে মাজা নায়, 
 বাপ চলিয়াছে মেয়েরে আনিতে সুদূরের ভিন গাঁয়। 
 বৈঠার ঘায়ে গলা জলে-ডোবা নাচিছে আমন ধান, 
 কলমির লতা জড়াইয়া তারে ফুলহাসি করে দান! 
 ঢ্যাপের মোয়ার চিত্রিত হাঁড়ি আবার ভরিয়া যায়, 
 পিঠায় আঁকিয়া নতুন নকশা রাত ভোর করে মায়। 

 জলের কন্যা চলেছে জলের পরে, 
 মাছেরা চলছে দলে দলে আজ পথটি তাহার ধরে। 
 রুহিত লাফায়, চিতল ফালায়, ভাটা মাছ সারি সারি, 
 সাথে সাথে যায় আগে পিছে ধায় খুশী যেন ওরা তারি। 
 শোল মাছ তার শিশুপোনাগুলি ছড়ায়ে লেজের ঘায়, 
 টুবটুব করে আদরিয়া পুন জড়াইছে বুক-ছায়; 
 নকসী কাঁথাটি মেলিয়া ধরিয়া গুমরে চাষার নারী, 
 সযতনে যেন গুটায়ে ধরিছে বুকের নিকটে তারি। 
 জলঘাসগুলি ঈষৎ কাঁপিছে তাদের চলার দোলে, 
 মৃদুল বাতাসে ঝুমিতেছে বন জলের দুনিয়া কোলে। 

 জলের কন্যা যায়, 
 নতুন পানির লিখন বহিয়া বন্ধ বিলের ছায়। 
 তটের বক্ষে আছাড়িয়া মাথা ক্ষতবিক্ষত করি, 
 বন্দী-মাছেরা কাটাইত দিন জীয়নে- যেন মরি। 
 অঙ্গ ভরিয়া শ্যাওলা জড়ান নির্জীব ঘুম-দোলে, 
 রোগ-পান্ডুর অসাড় দেহ যে পড়িতে চাহিছে ঢলে। 
 আজিকে নতুন জল-কল্লোল শুনিতে পেয়েছে তারা, 
 সহসা অঙ্গে হিল্লোলি ওঠে উধাও গতির ধারা! 
 কে যেন ঘোষিছে তাহাদের কানে সহস্র দিক হতে, 
 ভাঙ্ ভাঙ্ কারা ভাঙ্ ভাঙ্ পাড় উদ্দাম জলস্রোতে। 

 জলের কন্যা জল-পথ দিয়ে যায়, 
 বকের ছানারা পাখার আড়াল রচিছে তাহার গায়। 
 দুইধারে ঘন কেয়ার কুঞ্জ ছড়ায় সুবাস-রেণু 
 মাতাল বাতাস রহিয়া রহিয়া চুমিছে বনের বেনু। 
 তটে তটে কাঁদে শূন্য কলসী, কুটীরের দীপ ডাকে, 
 আঙিনার বেলী মাটিতে লুটায়, কে কুড়ায়ে লবে তাকে?

৯.             কল্যাণী 
              জসীমউদ্দীন


শোন, শোন মেয়ে, কার ঘর তুমি জড়ায়েছ জোছনায়, 
 রাঙা অনুরাগ ছড়ায়েছ তুমি কার মেহেদির ছায়! 
 কার আঙিনার ধূলি রাঙা হল চুমি ওই পদতল, 
 কারে দিলে তুমি সুশীতল ছায়া প্রসারিয়া অঞ্চল! 

 তুমি আকাশের চাঁদ হয়েছিলে, কাহার ফুলের শরে, 
 বিদ্ধ হইয়া হে নভচারিনী নেমেছ মাটির ঘরে! 
 কোন্ সে তমাল মেঘের মায়ায় ওগো বিদ্যুৎলতা! 
 ভুলিলে আজিকে বিরামবিহীন গতির চঞ্চলতা। 

 চির সুদূরিকা! কহ কহ তুমি, কাহার বাঁশীর সুরে 
 গ্রহতারকার অনাহত বাণী আনিয়াছ দেহপুরে। 
 সে কি জানিয়াছে যুগান্তপারে মহামন্থর শেষে, 
 নীলাম্বুদির তরঙ্গ পরে লক্ষ্মী দাঁড়াল এসে! 
 সে কি জানিয়াছে, মানস-সরের রাঙা মরালীর বায়, 
 সন্ধ্যা-সকাল এক দেহ ধরি দাঁড়ায়েছে নিরালায়! 

 ওগো কল্যাণী! কহ কহ মোরে, সে কি জানিয়াছে হায়! 
 ও ইন্দ্রধনু তনুখানি তব জড়াতে শ্যামল গায়, 
 তপস্যা-রত জল-ভরা মেঘ গগনে গগনে ঘোরে, 
 কামনা-যজ্ঞে লেলিহা বহ্নি মহাবিদ্যুতে পোড়ে! 
 সে কি জানিয়াছে, বাণীর ভ্রমরী ও অধর ফুল হতে 
 উড়িয়া আসিয়া হিয়ারে যে বেড়ে চিরজনমের ক্ষতে! 
 সে কি শিখিয়াছে, বাসক শয়নে ওই তনুদীপ জ্বালি 
 পতঙ্গ সম প্রতি পলে পলে আপনারে দিতে ঢালি! 
 ও অধর ভরা লাল পেয়ালার দ্রাক্ষারসের তরে, 
 জায়নামাজের বেচিয়াছে পাটি সুরা-বিক্রেতা ঘরে! 
 সে কি জপিয়ায়ে ওই নাম তব তবসী-মালার সনে, 
 সে কি ও নামের কোরান লিখিয়া পড়িয়াছে মনে মনে! 

 ওগো কল্যাণী! কহ কহ তুমি কেবা দরবেশ, 
 তোমার লাগিয়া মন-মোমবাতি পুড়ায়ে করিল শেষ! 
 কত বড় তার প্রসারিত বুক, আকাশে যে নাহি ধরে, 
 সেই বিদ্যুৎ বিহ্নরে আনি লুকাল বুকের ঘরে!

১০.            মুসাফির
               জসীমউদ্দীন


চলে মুসাফির গাহি, 
 এ জীবনে তার ব্যথা আছে শুধু, ব্যথার দোসর নাহি। 
 নয়ন ভরিয়া আছে আঁখিজল, কেহ নাই মুছাবার, 
 হৃদয় ভরিয়া কথার কাকলি, কেহ নাই শুনিবার। 
 চলে মুসাফির নির্জন পথে, দুপুরের উঁচু বেলা, 
 মাথার উপরে ঘুরিয়া ঘুরিয়া করিছে আগুন-খেলা। 
 দুধারে উধাও বৈশাখ-মাঠ রৌদ্রেরে বুকে চাপি, 
 ফাটলে ফাটলে চৌচির হয়ে করিতেছে দাপাদাপি। 
 নাচে উলঙ্গ দমকা বাতাস ধুলার বসন ছিঁড়ে, 
 ফুঁদিয়ে ফুঁদিয়ে আগুন জ্বালায় মাঠের ঢেলারে ঘিরে। 
 দুর পানে চাহি হাঁকে মুসাফির, আয়, আয়, আয়, আয়, 
 কস্পন জাগে খর দুপুরের আগুনের হলকায়। 
 তারি তালে তালে দুলে দুলে উঠে দুধারের স্তব্ধতা, 
 হেলে নীলাকাশ দিগনে- বেড়ি বাঁকা বনরেখা-লতা। 
 চলে মুসাফির দুর দুরাশার জনহীন পথ পাড়ি, 
 বুকে করাঘাত হানিয়া সে যেন কি ব্যথা দেখাবে ফাড়ি। 
 নামে দিগনে- দুপুরের বেলা, আসে এলোকেশী রাতি, 
 গলায় তাহার শত তারকার মুন্ডমালার বাতি। 
 মেঘের খাঁড়ায় রবিরে বনিয়া নাচে সে ভয়ঙ্করী, 
 দুর পশ্চিমে নিহত দিনের ছিন্নমুন্ড ধরি। 
 রুধির লেখায় দিগন্ত বায় লোল সে রসনা মেলি, 
 হাসে দিগনে- মত্ত ডাকিনী করিয়া রক্ত-কেলি। 
 চলেছে পথিক-চলেছে সে তার ভয়ঙ্করের পথে, 
 বেদনা তাহার সাথে সাথে চলে সুরের ইন্দ্ররথে। 
 ঘরে ঘরে জ্বলে সন্ধ্যার দীপ, মন্দিরে বাজে শাঁখ, 
 গাঁয়ের ভগ্ন মসজিদে বসি ডাকে দুটো দাঁড়কাক। 
 কবরে বসিয়া মাথা কুটে কাঁদে কার বিরহিনী মাতা, 
 চলেছে পথিক আপনার মনে বকিয়া বকিয়া যা-তা। 

 চলেছে পথিক-চলেছে পথিক-কতদুর-কতদুর, 
 আর কতদুর গেলে পরে সে যে পাবে দেখা বন্ধুর। 
 কেউ কি তাহার আশাপথ চাহি গণেছে বয়ষ মাস, 
 ধুঁয়ার ছলায় কাঁদিয়া কি কেউ ভিজায়েছে বেশবাস? 
 কিউ কি তাহারে দেখায়েছে দীপ কানো গেঁয়ো ঘর হতে, 
 মাথার কেশেতে পাঠায়েছে লেখা গংকিণী নদী সোঁতে? 

 চলেছে পথিক চলেছে সে তার ললাটের লেখা পড়ি, 
 সীমালেখাহীন পথ-মায়াবীর অঞ্চলখানি ধরি। 
 ঘরে ঘরে ওঠে মৃদু কোলাহল, বঁধুরা বধুর গলে, 
 বাহুর লতায় বাহুরে বাঁধিয়া প্রণয়-দোলায় দোলে। 
 বাঁশী বাজে দুরে সুখ-রজনীর মদিরা-সুবাস ঢালি, 
 দীঘির মুকুরে হেরে মুখ রাত চাঁদের প্রদীপ জ্বালি। 
 নতুন বধুর বক্ষে জড়ায়ে কচি শিশু বাহু তুলি, 
 হাসিয়া হাসিয়া ছড়াইছে যেন মণি-মানিকের ধুলি। 
 চলেছে পথিক-রহিয়া রহিয়া করিছে আর্তনাদ- 
 ও যেন ধরার সকল সুখের জীবন- প্রতিবাদ। 

 রে পথিক ! বল, কারে তুই চাস, যে তোরে এমন করে, 
 কাঁদাইল হায়, কেমন করিয়া রহিল সে আজ ঘরে? 
 কোন ছায়া-পথ নীহারিকা পারে, দেখেছিলি তুই কারে, 
 কোন সে কথার মানিক পাইয়া বিকাইলি আপনারে । 
 কার গেহ ছায়ে শুনেছিলি তুই চুড়ির রিণিকি-ঝিনি, 
 কে তোর ঘাটেতে এসেছিল ঘট বুড়াইতে একাকিনী । 

 চলে মুসাফির আপনার রাহে কোন দিকে নাহি চায়, 
 দুর বনপথে থাকিয়া থাকিয়া রাত-জাগা পাখি গায়। 
 গগনের পথে চাঁদেরে বেড়িয়া ডাকে পিউ, পিউ কাঁহা, 
 সে মৌন চাঁদ আজো হাসিতেছে, বলিল না, উহু আহা। 
 বউ কথা কও-বউ কথা কও-কতকাল -কতকাল, 
 রে উদাস, বল আর কতকাল পাতিবি সুরের জাল। 
 সে নিঠুর আজো কহিল না কথা, রহস্য-যবনিকা 
 খুলিয়া আজিও পরাল না কারো ললাটে প্রণয় টীকা। 
 চলেছে পথিক চলেছে সে তার দুর দুরাশার পারে, 
 কোনো পথবাঁকে পিছু ডাকে আজ ফিরাল না কেউ তারে। 
 চলেছে পথিক চলেছে সে যেন মৃত্যুর মত ধীরে, 
 যেন জীবন- হাহাকার আজি কাঁদিছে তাহার ঘিরে। 
 চারিদিক হতে গ্রাসিয়াছে তারে নিদারুণ আন্ধার, 
 স্তব্ধতা যেন জমাট বেঁধেছে ক্রন্দন শুনি তার।

১১.            খোসমানী
                জসীমউদ্দীন

তেপান্তরের মাঠেরে ভাই, রোদ ঝিম-ঝিম করে 
 রে ভাই, রোদ ঝিম-ঝিম করে ; 
 দুলছে সদাই ধুলার দোলায় ঘূর্ণি হাওয়ার ভরে। 
 মাঝখানে তার বট-বিরিক্ষি ঠান্ডা পাতার বায়ে, 
 বাতাসেরে শীতল করে ছড়ায় মাটির গায়ে। 
 সেথায় আছে খোসমানী সে সোনার বরণ গা, 
 বিজলী-বরণ হাত দুখানি আলতা-পরা পা। 
 সন্ধ্যাবেলা যখন এসে দাঁড়ায় প্রদীপ করে, 
 হাজার তারা ফুঠে ওঠে নীল আকাশের পরে। 
 পাকা তেলাকুচের ফলে রাঙাতে ঠোঁট দুটি, 
 সন্ধ্যা-সকাল রাঙা হয়ে হাসে কুটিকুটি। 
 রামধনু, তার শাড়ীর পাড়ে দোল খাইবে বলে, 
 সাতটি রঙের সাতটি হাসি ছড়ায় মেঘের দলে। 
 সাদা সাদা বকের ছানা নরম পাখা মেলে, 
 বলে, কন্যা, তোমার শাড়ীর পাড়ে ফিরব খেলে। 
 মেঘের গায়ে বিজলী মেখে বলে, কন্যা, আয়। 
 তোরে আজি জড়িয়ে নেব নীলাম্বরীর ছায়। 
 সে যখনে হাসে তখন হাসে যে ফুলগুলি, 
 গান গাহিলে বেড়ে তারে নাচে যে বুলবুলি। 
 সকাল হলে দুর্বাশীষের নীহার-জলে নেয়ে, 
 আকাশ দিয়ে নেচে বেড়ায় ফুলের রেণু খেয়ে। 
 এই খুকীটির সঙ্গে তোমার আলাপ যদি থাকে, 
 ব’লো যেন আসমানীরে বারেক কাছে ডাকে। 

কবিতা গুলো লেখার মধ্য যদি কোন ভুল হয়ে থাকে।তাহলে ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।
পরর্বতী পর্বে আরো কিছু কবিতা দেওয়া হয়েছে।


No comments

Theme images by diane555. Powered by Blogger.