মাইকেল মধুসূদন দত্তের সেরা ১৫ টি কবিতা
আসসালামু আলাইকুম, বন্ধুরা সবাই কেমন আছেন,,,?? Technical Bangla পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।
হ্যালো বন্ধুরা কবিতা পর্ব-৭: এ আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।আমি আজকে নিয়ে আসলাম কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর লেখা ১৫ টি কবিতা গুলো সবাই মনযোগ দিয়ে পড়বেন।মাইকেল মধুসূদন দত্ত কে সনেটের জনক বলা হয়।
চলুন দেখে আসি কবিতা গুলো-
১. কপোতাক্ষ নদ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।
সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে
দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।
আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি রূপ কর তুমি এ মিনতি গাবে
বঙ্গজ জনের কানে সখে-সখারিতে।
নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে
লইছে যে নাম তব বঙ্গের সঙ্গীতে।
২. সৃষ্টিকর্ত্তা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কে সৃজিলা এ সুবিশ্বে, জিজ্ঞাসিব কারে
এ রহস্য কথা, বিশ্বে, আমি মন্দমতি?
পার যদি, তুমি দাসে কহ, বসুমতি,
দেহ মহা-দীক্ষা, দেবি, ভিক্ষা চিনিবারে
তাঁহায়, প্রসাদে যাঁর তুমি, রূপবতি,
ভ্রম অসম্ভ্রমে শূন্যে! কহ, হে আমারে,
কে তিনি, দীনেশ রবি, করি এ মিনতি,
যাঁর আদি জ্যোতিঃ হেম-আলোক সঞ্চারে
তোমার বদন, দেব, প্রত্যহ উজ্জ্বলে?
অধম চিনিতে চাহে সে পরম জনে,
যাঁহার প্রসাদে তুমি নক্ষত্র-মন্ডলে
কর কেলি নিশাকালে রজত-আসনে,
নিশানাথ। নদকুল, কহ, কল কলে,
কিম্বা তুমি, অম্বুপাতি গম্ভীর স্বননে।
৩. সূর্য্য
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
এখন ও আছে লোক দেশ দেশান্তরে
দেব ভাবি পূজে তোমা, রবি দিনমণি,
দেখি তোমা দিবামুখে উদয়-শিখরে,
লুটায়ে ধরণিতলে, করে স্তুতি-ধ্বনি,
আশ্চর্য্যের কথা, সূর্য্য, এ না মনে গণি।
অসীম মহিমা তব, যখন প্রখরে
শোভ তুমি, বিভাবসু, মধ্যাহ্নে অম্বরে
সমুজ্জ্বল করজালে আবরি মেদিনী!
অসীম মহিমা তব, অসীম শকতি,
হেম-জ্যোতিঃ দাতা তুমি চন্দ্র-গ্রহ-দলে,
উর্ব্বরা তোমার বীর্য্যে সতী বসুমতী,
বারিদ, প্রসাদে তব, সদা পূর্ণ জলে,
কিন্তু কি মহিমা তাঁর, কহ, দিনপতি,
কোটি রবি শোভে নিত্য যাঁর পদতলে!
৪. সাগরে তরি
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
হেরিনু নিশায় তরি অপথ সাগরে,
মহাকায়া, নিশাচরী, যেন মায়া-বলে,
বিহঙ্গিনী-রূপ ধরি, ধীরে ধীরে চলে,
রঙ্গে সুধবল পাখা বিস্তারি অম্বরে!
রতনের চড়া-রূপে শিরোদেশে জ্বলে
দীপাবলি, মনোহরা নানা বড়ড়ণ করে,
শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত, মিশ্রিত পিঙ্গলে।
চারি দিকে ফেনাময় তরঙ্গ সুস্বরে
গাইছে আনন্দে যেন, হেরি এ সুন্দরী
বামারে, বাক্ষানি রূপ, সাহস, আকৃতি।
ছাড়িতেছে পথ সবে আস্তে ব্যস্তে সরি,
নীচ জন হেরি যথা কুলের যুবতী।
চলিছে গুমরে বামা পথ আলো করি,
শিরোমণি-তেজে যথা ফণিনীর গতি।
৫. সাংসারিক জ্ঞান
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কি কাজে বাজায়ে বীণা, কি কাজ জাগায়ে
সুমধুর প্রতিধ্বনি কাব্যের কাননে?
কি কাজ গরজে ঘন কাব্যের গগনে
মেঘ-রূপে, মনোরূপ ময়ূরে নাচায়ে?
স্বতরিতে তুলি তোরে বেড়াবে কি বায়ে
সংসার-সাগর-জলে, স্নেহ করি মনে
কোন জন? দেবে অন্ন অর্দ্ধ মাত্র খায়ে,
ক্ষুধায় কাতর তোরে দেখি রে তোরণে?
ছিঁড়ি তার-কুল, বীণা ছুড়ি ফেল দূরে!
কহে সাংসারিক জ্ঞান -ভবে বৃহস্পতি।
কিন্তু চিত্ত-ক্ষেত্রে যবে এ বীজ অঙ্কুরে,
উপাড়ে উহায় হেন কাহার শকতি?
উসাসীন-দশী তার সদা জীব-পুরে,
যে অভাগা রাঙা পদ ভজে, মা ভারতি!
৬. শীমান্তের টোপর
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
হেরি যথা সফরীরে স্বচ্ছ সরোবরে,
পড়ে মতস্যরঙ্ক, ভেদি সুনীল গগনে,
(ইন্দ্র-ধনুঃ সম দীপ্ত বিবিধ বরণে)
পড়িল মুকুট, উঠি, অকূল সাগরে,
উজলি চৌদিক শত রতনের করে
দ্রুতগতি! মৃদু হাসি হেম ঘনাসনে
আকাশে, সম্ভাষি দেবী, সুমধুর স্বরে,
পদ্মারে, কহিলা, 'দেখ, দেখ লো নয়নে,
অবোধ শ্রীমন্ত ফেলে সাগরের জলে
লক্ষের টোপর, সখি! রক্ষিব, স্বজনি,
খুল্লনার ধন আমি। -আশু মায়া-বলে
স্বররণ ক্ষেমঙ্করী-রূপ লইলা জননী।
বজ্রনখে মতস্যরঙ্কে যথা নভস্তলে
বিঁধে বাজ, টোপর মা ধরিলা তেমনি।
৭. শ্যামা-পক্ষী
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
আঁধার পিঞ্জরে তুই, রে কুঞ্জ-বিহারি
বিহঙ্গ, কি রঙ্গে গীত গাইস সুস্বরে?
ক মোরে, পূর্ব্বের সুখ কেমনে বিস্মরে
মনঃ তোর? বুঝা রে, যা বুঝিতে না পারি!
সঙ্গীত-তরঙ্গ-সঙ্গে মিশি কি রে ঝরে
অদৃশ্যে ও কারাগারে নয়নের বারি?
রোদন-নিনাদ কি রে লোকে মনে করে
মধুমাখা গীত-ধ্বনি, অজ্ঞানে বিচারি?
কে ভাবে, হৃদয়ে তোর কি ভাব উথলে?
কবির কুভাগ্য তোর, আমি ভাবি মনে।
দুখের আঁধারে মজি গাইস বিরলে
তুই, পাখি, মজায়ে রে মধু-বরিষণে!
কে জানে যাতনা কত তোর ভব-তলে?
মোহে গন্ধে গন্ধরস সহি হুতাসনে!
৮. রামায়ণ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সাধিনু নিদ্রায় বৃথা সুন্দর সিংহলে।
স্মৃতি, পিতা বাল্মীকির বৃদ্ধ-রূপ ধরি,
বসিলা শিয়ারে মোর, হাতে বীণা করি,
গাইলা সে মহাগীত, যাহে হিয়া জ্বলে,
যাহে আজু আঁখি হতে অশ্রু-বিন্দু গলে!
কে সে মূঢ় ভূভারতে, বৈদেহি সুন্দরি,
নাহি আর্দ্রে মনঃ যার তব কথা স্মরি,
নিত্য-কান্তি কমলিনী তুমি ভক্তি-জলে!
দিব্য চক্ষুঃ দিলা গুরু, দেখিনু সুক্ষণে
শিলা জলে, কুম্ভকর্ণ পশিল সমরে,
চলিল অচল যেন ভীষণ ঘোষণে,
কাঁপায়ে ধরায় ঘন ভীম-পদ-ভরে।
বিনাশিলা রামানুজ মেঘনাদে রণে,
বিনাশিলা রঘুরাজ মেঘনাদে রণে,
বিনাশিলা রঘুরাজ রক্ষোরাজেশ্বরে।
৯. মহাভারত
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কল্পনা-বাহনে সুখে করি আরোহণ,
উতরিনু, যথা বসি বদরীর তলে,
করে বীণা, গাইছেন গীত কুতূহলে
সত্যবতী-সুত কবি, -ঋষিকুল -ধন!
শুনিনু গম্ভির ধ্বনি, উন্মীল নয়ন
দেখিনু কৌরবেশ্বরে, মত্ত বাহুবলে,
দেখিনু পবন-পুত্রে, ঝড় যথা চলে
হুঙ্কারে! আইলা কর্ণ -সূর্য্যের নন্দন
তেজস্বী। উজ্জ্বলি যথা ছোটে অনম্বরে
নক্ষত্র, আইলা ক্ষেত্রে পার্থ মহামতি,
আলো করি দশ দিশ, ধরি বাম করে
গান্ডীব -প্রচন্ড-দন্ড-দাতা রিপু প্রতি।
তরাসে আকুল হৈনু এ কাল সমরে,
দ্বাপরে গোগৃহ রণে উত্তর যেমতি।
১০. মধুকর
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
শুনি গুন গুন ধ্বনি তোর এ কাননে,
মধুকর, এ পরাণ কাঁদে রে বিষাদে!
ফুল-কুল-বধু-দলে সাধিস যতনে
অনুক্ষণ, মাগি ভিক্ষা অতি মৃদু নাদে,
তুমকী বাজায়ে যথা রাজার তোরণে
ভিখারী, কি হেতু তুই? ক মোরে, কি সাদে
মোমের ভান্ডারে মধু রাখিস গোপনে,
ইন্দ্র যথা চন্দ্রলোকে, দানব-বিবাদে,
সুধামৃত? এ আয়াসে কি সুফল ফলে?
কৃপনের ভাগ্য তোর! কৃপণ যেমতি
অনাহারে, অনিদ্রায়, সঞ্চয়ে বিকলে
বৃথা অর্থ, বিধি-বশে তোর সে দুর্গতি!
গৃহ-চ্যুত করি তোরে, লুটি লয় বলে,
পর জন পরে তোর শ্রমের সঙ্গিত!
১১. ভাষা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
লো সুন্দরী জননীর
সুন্দরীতর দুহিতা!
মূঢ় সে, পন্ডিত-গণে তাহে নাহি গণি,
কহে যে, রূপসী তুমি নহ, লো সুন্দরি
ভাষা! শত ধিক তারে! ভূলে সে কি করি
শকুন্তলা তুমি, তব মেনকা জননী?
রূপ-হীনা। দুহিতা কি, মা যার অপ্সরী?
বীণার রসনা-মূলে জন্মে কি কুধ্বনি?
কবে মন্দ-গন্ধ শ্বাস শ্বাসে ফুলেশ্বরী
নলিনী? সীতার গর্ভে ধরিলা ধরণী
দেব-যোনি মা তোমার, কাল নাহি নাশে
রূপ তাঁর, তবু কাল করে কিছু ক্ষতি।
নব রস-সুধা কোথা বয়সের হাসে?
কালে সুবর্ণের বর্ণ ম্লান, লো যুবতি!
নব শশিকলা তুমি ভারত-আকাশে,
নব-ফুল বাক্য-বনে, নব মধুমতী।
১২. পৃথিবী
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
নির্ম্মি গোলাকারে তোমা আরোপিলা যবে
বিশ্ব-মাঝে স্রষ্টা, ধরা! অতি হৃষ্ট মনে
চারি দিকে তারা-চয় সুমধুর রবে
(বাজায়ে সুবর্ণ বীণা) গাইল গগনে,
কুল-বালা-দল যবে বিবাহ-উতসবে
হুলাহুলি দেয় মিলি বধূ-দরশনে।
আইলেন আদি প্রভা হেম-ঘনাসনে,
ভাসি ধীরে শূন্যরূপ সুনীল অর্ণবে,
দেখিতে তোমার মুখ। বসন্ত আপনি
আবরিলা শ্যাম বাসে বর কলেবরে,
আঁচলে বসায়ে মব ফুলরূপ মণি,
নব ফুল-রূপ মণি কবরী উপরে।
দেবীর আদেশে তুমি, লো নব রমণি,
কটিতে মেখলা-রূপে পরিলা সাগরে।
১৩. বটবৃক্ষ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
দেব-অবতার ভাবি বন্দে যে তোমারে,
নাহি চাহে মনঃ মোর তাহে নিন্দা করি,
তরুরাজ! প্রত্যক্ষতঃ ভারত-সংসারে,
বিধির করুণা তুমি তরু-রূপ ধরি!
জীবকুল-হিতৈষিণী, ছায়া সু-সুন্দরী,
তোমার দুহিতা, সাধু! যবে বসুধারে
দগধে আগ্নেয় তাপে, দয়া পরিহরি,
মিহির, আকুল জীব বাঁচে পূজি তাঁরে।
শত-পত্রময় মঞ্চে, তোমার সদনে,
খেচর- অতিথি ব্রজ, বিরাজে সতত,
পদ্মরাগ ফলপুঞ্জে ভুঞ্জি হৃষ্ট -মনে,
মৃদু-ভাষে মিষ্টালাপ কর তুমি কত,
মিষ্টালাপি, দেহ-দাহ শীতলি যতনে!
দেব নহ, কিন্তু গুণে দেবতার মত।
১৪. প্রাণ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কি সুরাজ্যে, প্রাণ, তব রাজ-সিংহাসন!
বাহু-রূপে দুই রথী, দুর্জ্জয় সমরে,
বিধির বিধানে পুরী তব রক্ষা করে,
পঞ্চ অনুচর তোমা সেবে অনুক্ষণ।
সুহাসে ঘ্রাণের গন্ধ দেয় ফুলবন,
যতনে শ্রবণ আনে সুমধুর স্বরে,
সুন্দর যা কিছু আছে, দেখায় দর্শন
ভূতলে, সুনীল নভে, সর্ব্ব চরাচরে!
স্পর্শ, স্বাদ, সদা ভোগ যোগায়, সুমতি!
পদরূপে দুই বাজী তব রাজ-দ্বারে,
জ্ঞান-দেব মন্ত্রী তব -ভবে বৃহস্পতি,
সরস্বতী অবতার রসনা সংসারে!
স্বর্ণস্রোতোরূপে লহু, অবিরল-গতি,
বহ্নি অঙ্গে, রঙ্গে ধনী করে হে তোমারে!
১৫. বসন্তে একটি পাখীর প্রতি
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
নহ তুমি পিক, পাখি, বিখ্যাত ভারতে,
মাধবের বার্ত্তাবহ, যার কুহরণে
ফোটে কোটি ফুল-পুঞ্জ মঞ্জু কুঞ্জবনে!
তবুও সঙ্গীত-রঙ্গ করিছ যে মতে
গায়ক, পুলক তাহে জনমে এ মনে!
মধুময় মধুকাল সর্ব্বত্র জগতে,
কে কোথা মলিন কবে মধুর মিলনে,
বসুমতী সতী যবে রত প্রেমরতে?
দুরন্ত কৃতান্ত-সম হেমন্ত এ দেশে
নির্দ্দয়, ধরার কষ্টে দুষ্ট তুষ্ট অতি!
না দেয় শোভিতে কভু ফুলরত্নে কেশে,
পরায় ধবল বাস বৈধব্যে যেমতি!
ডাক তুমি ঋতুরাজে, মনোহর বেশে
সাজাতে ধরায় আসি, ডাক শীঘ্রগতি!
মাইকেল মধুসূদন দত্তের কিছু কবিতা দেওয়া হয়েছে।আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। পরবর্তী পর্ব পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।
হ্যালো বন্ধুরা কবিতা পর্ব-৭: এ আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।আমি আজকে নিয়ে আসলাম কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এর লেখা ১৫ টি কবিতা গুলো সবাই মনযোগ দিয়ে পড়বেন।মাইকেল মধুসূদন দত্ত কে সনেটের জনক বলা হয়।
চলুন দেখে আসি কবিতা গুলো-
১. কপোতাক্ষ নদ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।
সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া যন্ত্র ধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।
বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে
দুগ্ধস্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।
আর কি হে হবে দেখা যত দিন যাবে
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি রূপ কর তুমি এ মিনতি গাবে
বঙ্গজ জনের কানে সখে-সখারিতে।
নাম তার এ প্রবাসে মজি প্রেমভাবে
লইছে যে নাম তব বঙ্গের সঙ্গীতে।
২. সৃষ্টিকর্ত্তা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কে সৃজিলা এ সুবিশ্বে, জিজ্ঞাসিব কারে
এ রহস্য কথা, বিশ্বে, আমি মন্দমতি?
পার যদি, তুমি দাসে কহ, বসুমতি,
দেহ মহা-দীক্ষা, দেবি, ভিক্ষা চিনিবারে
তাঁহায়, প্রসাদে যাঁর তুমি, রূপবতি,
ভ্রম অসম্ভ্রমে শূন্যে! কহ, হে আমারে,
কে তিনি, দীনেশ রবি, করি এ মিনতি,
যাঁর আদি জ্যোতিঃ হেম-আলোক সঞ্চারে
তোমার বদন, দেব, প্রত্যহ উজ্জ্বলে?
অধম চিনিতে চাহে সে পরম জনে,
যাঁহার প্রসাদে তুমি নক্ষত্র-মন্ডলে
কর কেলি নিশাকালে রজত-আসনে,
নিশানাথ। নদকুল, কহ, কল কলে,
কিম্বা তুমি, অম্বুপাতি গম্ভীর স্বননে।
৩. সূর্য্য
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
এখন ও আছে লোক দেশ দেশান্তরে
দেব ভাবি পূজে তোমা, রবি দিনমণি,
দেখি তোমা দিবামুখে উদয়-শিখরে,
লুটায়ে ধরণিতলে, করে স্তুতি-ধ্বনি,
আশ্চর্য্যের কথা, সূর্য্য, এ না মনে গণি।
অসীম মহিমা তব, যখন প্রখরে
শোভ তুমি, বিভাবসু, মধ্যাহ্নে অম্বরে
সমুজ্জ্বল করজালে আবরি মেদিনী!
অসীম মহিমা তব, অসীম শকতি,
হেম-জ্যোতিঃ দাতা তুমি চন্দ্র-গ্রহ-দলে,
উর্ব্বরা তোমার বীর্য্যে সতী বসুমতী,
বারিদ, প্রসাদে তব, সদা পূর্ণ জলে,
কিন্তু কি মহিমা তাঁর, কহ, দিনপতি,
কোটি রবি শোভে নিত্য যাঁর পদতলে!
৪. সাগরে তরি
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
হেরিনু নিশায় তরি অপথ সাগরে,
মহাকায়া, নিশাচরী, যেন মায়া-বলে,
বিহঙ্গিনী-রূপ ধরি, ধীরে ধীরে চলে,
রঙ্গে সুধবল পাখা বিস্তারি অম্বরে!
রতনের চড়া-রূপে শিরোদেশে জ্বলে
দীপাবলি, মনোহরা নানা বড়ড়ণ করে,
শ্বেত, রক্ত, নীল, পীত, মিশ্রিত পিঙ্গলে।
চারি দিকে ফেনাময় তরঙ্গ সুস্বরে
গাইছে আনন্দে যেন, হেরি এ সুন্দরী
বামারে, বাক্ষানি রূপ, সাহস, আকৃতি।
ছাড়িতেছে পথ সবে আস্তে ব্যস্তে সরি,
নীচ জন হেরি যথা কুলের যুবতী।
চলিছে গুমরে বামা পথ আলো করি,
শিরোমণি-তেজে যথা ফণিনীর গতি।
৫. সাংসারিক জ্ঞান
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কি কাজে বাজায়ে বীণা, কি কাজ জাগায়ে
সুমধুর প্রতিধ্বনি কাব্যের কাননে?
কি কাজ গরজে ঘন কাব্যের গগনে
মেঘ-রূপে, মনোরূপ ময়ূরে নাচায়ে?
স্বতরিতে তুলি তোরে বেড়াবে কি বায়ে
সংসার-সাগর-জলে, স্নেহ করি মনে
কোন জন? দেবে অন্ন অর্দ্ধ মাত্র খায়ে,
ক্ষুধায় কাতর তোরে দেখি রে তোরণে?
ছিঁড়ি তার-কুল, বীণা ছুড়ি ফেল দূরে!
কহে সাংসারিক জ্ঞান -ভবে বৃহস্পতি।
কিন্তু চিত্ত-ক্ষেত্রে যবে এ বীজ অঙ্কুরে,
উপাড়ে উহায় হেন কাহার শকতি?
উসাসীন-দশী তার সদা জীব-পুরে,
যে অভাগা রাঙা পদ ভজে, মা ভারতি!
৬. শীমান্তের টোপর
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
হেরি যথা সফরীরে স্বচ্ছ সরোবরে,
পড়ে মতস্যরঙ্ক, ভেদি সুনীল গগনে,
(ইন্দ্র-ধনুঃ সম দীপ্ত বিবিধ বরণে)
পড়িল মুকুট, উঠি, অকূল সাগরে,
উজলি চৌদিক শত রতনের করে
দ্রুতগতি! মৃদু হাসি হেম ঘনাসনে
আকাশে, সম্ভাষি দেবী, সুমধুর স্বরে,
পদ্মারে, কহিলা, 'দেখ, দেখ লো নয়নে,
অবোধ শ্রীমন্ত ফেলে সাগরের জলে
লক্ষের টোপর, সখি! রক্ষিব, স্বজনি,
খুল্লনার ধন আমি। -আশু মায়া-বলে
স্বররণ ক্ষেমঙ্করী-রূপ লইলা জননী।
বজ্রনখে মতস্যরঙ্কে যথা নভস্তলে
বিঁধে বাজ, টোপর মা ধরিলা তেমনি।
৭. শ্যামা-পক্ষী
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
আঁধার পিঞ্জরে তুই, রে কুঞ্জ-বিহারি
বিহঙ্গ, কি রঙ্গে গীত গাইস সুস্বরে?
ক মোরে, পূর্ব্বের সুখ কেমনে বিস্মরে
মনঃ তোর? বুঝা রে, যা বুঝিতে না পারি!
সঙ্গীত-তরঙ্গ-সঙ্গে মিশি কি রে ঝরে
অদৃশ্যে ও কারাগারে নয়নের বারি?
রোদন-নিনাদ কি রে লোকে মনে করে
মধুমাখা গীত-ধ্বনি, অজ্ঞানে বিচারি?
কে ভাবে, হৃদয়ে তোর কি ভাব উথলে?
কবির কুভাগ্য তোর, আমি ভাবি মনে।
দুখের আঁধারে মজি গাইস বিরলে
তুই, পাখি, মজায়ে রে মধু-বরিষণে!
কে জানে যাতনা কত তোর ভব-তলে?
মোহে গন্ধে গন্ধরস সহি হুতাসনে!
৮. রামায়ণ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
সাধিনু নিদ্রায় বৃথা সুন্দর সিংহলে।
স্মৃতি, পিতা বাল্মীকির বৃদ্ধ-রূপ ধরি,
বসিলা শিয়ারে মোর, হাতে বীণা করি,
গাইলা সে মহাগীত, যাহে হিয়া জ্বলে,
যাহে আজু আঁখি হতে অশ্রু-বিন্দু গলে!
কে সে মূঢ় ভূভারতে, বৈদেহি সুন্দরি,
নাহি আর্দ্রে মনঃ যার তব কথা স্মরি,
নিত্য-কান্তি কমলিনী তুমি ভক্তি-জলে!
দিব্য চক্ষুঃ দিলা গুরু, দেখিনু সুক্ষণে
শিলা জলে, কুম্ভকর্ণ পশিল সমরে,
চলিল অচল যেন ভীষণ ঘোষণে,
কাঁপায়ে ধরায় ঘন ভীম-পদ-ভরে।
বিনাশিলা রামানুজ মেঘনাদে রণে,
বিনাশিলা রঘুরাজ মেঘনাদে রণে,
বিনাশিলা রঘুরাজ রক্ষোরাজেশ্বরে।
৯. মহাভারত
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কল্পনা-বাহনে সুখে করি আরোহণ,
উতরিনু, যথা বসি বদরীর তলে,
করে বীণা, গাইছেন গীত কুতূহলে
সত্যবতী-সুত কবি, -ঋষিকুল -ধন!
শুনিনু গম্ভির ধ্বনি, উন্মীল নয়ন
দেখিনু কৌরবেশ্বরে, মত্ত বাহুবলে,
দেখিনু পবন-পুত্রে, ঝড় যথা চলে
হুঙ্কারে! আইলা কর্ণ -সূর্য্যের নন্দন
তেজস্বী। উজ্জ্বলি যথা ছোটে অনম্বরে
নক্ষত্র, আইলা ক্ষেত্রে পার্থ মহামতি,
আলো করি দশ দিশ, ধরি বাম করে
গান্ডীব -প্রচন্ড-দন্ড-দাতা রিপু প্রতি।
তরাসে আকুল হৈনু এ কাল সমরে,
দ্বাপরে গোগৃহ রণে উত্তর যেমতি।
১০. মধুকর
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
শুনি গুন গুন ধ্বনি তোর এ কাননে,
মধুকর, এ পরাণ কাঁদে রে বিষাদে!
ফুল-কুল-বধু-দলে সাধিস যতনে
অনুক্ষণ, মাগি ভিক্ষা অতি মৃদু নাদে,
তুমকী বাজায়ে যথা রাজার তোরণে
ভিখারী, কি হেতু তুই? ক মোরে, কি সাদে
মোমের ভান্ডারে মধু রাখিস গোপনে,
ইন্দ্র যথা চন্দ্রলোকে, দানব-বিবাদে,
সুধামৃত? এ আয়াসে কি সুফল ফলে?
কৃপনের ভাগ্য তোর! কৃপণ যেমতি
অনাহারে, অনিদ্রায়, সঞ্চয়ে বিকলে
বৃথা অর্থ, বিধি-বশে তোর সে দুর্গতি!
গৃহ-চ্যুত করি তোরে, লুটি লয় বলে,
পর জন পরে তোর শ্রমের সঙ্গিত!
১১. ভাষা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
লো সুন্দরী জননীর
সুন্দরীতর দুহিতা!
মূঢ় সে, পন্ডিত-গণে তাহে নাহি গণি,
কহে যে, রূপসী তুমি নহ, লো সুন্দরি
ভাষা! শত ধিক তারে! ভূলে সে কি করি
শকুন্তলা তুমি, তব মেনকা জননী?
রূপ-হীনা। দুহিতা কি, মা যার অপ্সরী?
বীণার রসনা-মূলে জন্মে কি কুধ্বনি?
কবে মন্দ-গন্ধ শ্বাস শ্বাসে ফুলেশ্বরী
নলিনী? সীতার গর্ভে ধরিলা ধরণী
দেব-যোনি মা তোমার, কাল নাহি নাশে
রূপ তাঁর, তবু কাল করে কিছু ক্ষতি।
নব রস-সুধা কোথা বয়সের হাসে?
কালে সুবর্ণের বর্ণ ম্লান, লো যুবতি!
নব শশিকলা তুমি ভারত-আকাশে,
নব-ফুল বাক্য-বনে, নব মধুমতী।
১২. পৃথিবী
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
নির্ম্মি গোলাকারে তোমা আরোপিলা যবে
বিশ্ব-মাঝে স্রষ্টা, ধরা! অতি হৃষ্ট মনে
চারি দিকে তারা-চয় সুমধুর রবে
(বাজায়ে সুবর্ণ বীণা) গাইল গগনে,
কুল-বালা-দল যবে বিবাহ-উতসবে
হুলাহুলি দেয় মিলি বধূ-দরশনে।
আইলেন আদি প্রভা হেম-ঘনাসনে,
ভাসি ধীরে শূন্যরূপ সুনীল অর্ণবে,
দেখিতে তোমার মুখ। বসন্ত আপনি
আবরিলা শ্যাম বাসে বর কলেবরে,
আঁচলে বসায়ে মব ফুলরূপ মণি,
নব ফুল-রূপ মণি কবরী উপরে।
দেবীর আদেশে তুমি, লো নব রমণি,
কটিতে মেখলা-রূপে পরিলা সাগরে।
১৩. বটবৃক্ষ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
দেব-অবতার ভাবি বন্দে যে তোমারে,
নাহি চাহে মনঃ মোর তাহে নিন্দা করি,
তরুরাজ! প্রত্যক্ষতঃ ভারত-সংসারে,
বিধির করুণা তুমি তরু-রূপ ধরি!
জীবকুল-হিতৈষিণী, ছায়া সু-সুন্দরী,
তোমার দুহিতা, সাধু! যবে বসুধারে
দগধে আগ্নেয় তাপে, দয়া পরিহরি,
মিহির, আকুল জীব বাঁচে পূজি তাঁরে।
শত-পত্রময় মঞ্চে, তোমার সদনে,
খেচর- অতিথি ব্রজ, বিরাজে সতত,
পদ্মরাগ ফলপুঞ্জে ভুঞ্জি হৃষ্ট -মনে,
মৃদু-ভাষে মিষ্টালাপ কর তুমি কত,
মিষ্টালাপি, দেহ-দাহ শীতলি যতনে!
দেব নহ, কিন্তু গুণে দেবতার মত।
১৪. প্রাণ
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
কি সুরাজ্যে, প্রাণ, তব রাজ-সিংহাসন!
বাহু-রূপে দুই রথী, দুর্জ্জয় সমরে,
বিধির বিধানে পুরী তব রক্ষা করে,
পঞ্চ অনুচর তোমা সেবে অনুক্ষণ।
সুহাসে ঘ্রাণের গন্ধ দেয় ফুলবন,
যতনে শ্রবণ আনে সুমধুর স্বরে,
সুন্দর যা কিছু আছে, দেখায় দর্শন
ভূতলে, সুনীল নভে, সর্ব্ব চরাচরে!
স্পর্শ, স্বাদ, সদা ভোগ যোগায়, সুমতি!
পদরূপে দুই বাজী তব রাজ-দ্বারে,
জ্ঞান-দেব মন্ত্রী তব -ভবে বৃহস্পতি,
সরস্বতী অবতার রসনা সংসারে!
স্বর্ণস্রোতোরূপে লহু, অবিরল-গতি,
বহ্নি অঙ্গে, রঙ্গে ধনী করে হে তোমারে!
১৫. বসন্তে একটি পাখীর প্রতি
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
নহ তুমি পিক, পাখি, বিখ্যাত ভারতে,
মাধবের বার্ত্তাবহ, যার কুহরণে
ফোটে কোটি ফুল-পুঞ্জ মঞ্জু কুঞ্জবনে!
তবুও সঙ্গীত-রঙ্গ করিছ যে মতে
গায়ক, পুলক তাহে জনমে এ মনে!
মধুময় মধুকাল সর্ব্বত্র জগতে,
কে কোথা মলিন কবে মধুর মিলনে,
বসুমতী সতী যবে রত প্রেমরতে?
দুরন্ত কৃতান্ত-সম হেমন্ত এ দেশে
নির্দ্দয়, ধরার কষ্টে দুষ্ট তুষ্ট অতি!
না দেয় শোভিতে কভু ফুলরত্নে কেশে,
পরায় ধবল বাস বৈধব্যে যেমতি!
ডাক তুমি ঋতুরাজে, মনোহর বেশে
সাজাতে ধরায় আসি, ডাক শীঘ্রগতি!
মাইকেল মধুসূদন দত্তের কিছু কবিতা দেওয়া হয়েছে।আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। পরবর্তী পর্ব পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।
No comments