জীবনানন্দ দাসের কবিতা-সমূহ - TECHNICAL BANGLA

জীবনানন্দ দাসের কবিতা-সমূহ

আসসালামু আলাইকুম, বন্ধুরা সবাই কেমন আছেন,,,?? Technical Bangla পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।

হ্যালো বন্ধুরা কবিতা পর্ব-৮: এ আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।আমি আজকে নিয়ে আসলাম কবি জীবনানন্দ  দাস  এর লেখা ১৫ টি কবিতা গুলো সবাই মনযোগ দিয়ে পড়বেন।
চলুন দেখে আসি কবিতা গুলো-  


১.     অদ্ভুত আঁধার এক
          জীবনানন্দ  দাস

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,  
 যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;  
 যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই  
 পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।  
 যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি  
 এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়  
 মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা  
 শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

২.     বনলতা সেন
       জীবনানন্দ  দাস


হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,  
 সিংহল সমুদ্র থেকে আরো দূর অন্ধকারে মালয় সাগরে  
 অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে  
 সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে;  
 আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,  
 আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।  
  
 চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,  
 মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর  
 হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা  
 সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,  
 তেমনই দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’  
 পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে চাওয়া নাটোরের বনলতা সেন।  
  
 সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন  
 সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;  
 পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন,  
 তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল।  
 সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী; ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;  
 থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

৩.     আবার আসিব ফিরে
            জীবনানন্দ  দাস

আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে -এই বাংলায়  
 হয়তো মানুষ নয় -হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;  
 হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে  
 কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঠাঁলছায়ায়;  
 হয়তো বা হাঁস হব -কিশোরীর -ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,  
 সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে;  
 আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে  
 জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;  
  
 হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে;  
 হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেচাঁ ডাকিতেছে শিমুলের ডালে;  
 হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে;  
 রূপসা ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে  
 ডিঙা রায় -রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে  
 দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।

৪.  একদিন কুয়াশার এই মাঠে 
            জীবনানন্দ  দাস


একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;  
 হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেই দিন -গিয়েছে যে শান -হিম ঘরে,  
 অথবা সান্ত্বনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল -পৃথিবীর এই মাঠখানি  
 ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন, এ মাঠের কয়েকটি শালিকের তরে  
  
 আশ্চর্য আর বিস্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধকার বিছানার কোলে,  
 আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে আজো কি মাঠের কুয়াশায়  
 ভেসে আসে? সেই ন্যাড়া অম্বনে’র পানে আজো চলে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো হলে  
 ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়?  
  
 সন্ধ্যা হলে? মউমাছি চাক আজো বাঁধে নাকি জামের নিবিড় ঘন ডালে,  
 মউ খাওয়া হয়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় কুয়াশায় সন্ধ্যার বাতাসে-  
 কতো দূরে যায়, আহা… অথবা হয়তো কেউ চালতার ঝরাপাতা জ্বালে  
 মধুর চাকের নিচে -মাছিগুলো উড়ে যায়… ঝ’রে পড়ে… ম’রে থাকে ঘাসে।

৫.   আমাকে একটি কথা দাও
         জীবনানন্দ  দাস


আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো  
 সহজ মহৎ বিশাল,  
 গভীর; – সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে  
 মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,  
 আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।  
  
 সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো:  
 সেই দিনের – আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন  
 সেই উজ্জ্বল পাখিনীর – পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে  
 অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।

৬.    বছর কুড়ি পরে
       জীবনানন্দ  দাস


আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা যদি হয়  
 আবার বছর কুড়ি পরে-  
 হয়তো ধানের ছড়ার পাশে  
 কার্তিকের মাসে-  
 তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে- তখন হলুদ নদী  
 নরম নরম শর কাশ হোগলায়- মাঠের ভিতরে!  
  
 অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,  
 ব্যস্ততা নাই আর,  
 হাঁসের নীড়ের থেকে খড়  
 পাখির নীড় থেকে খড়  
 ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল!  
 জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি, কুড়ি, বছরের পার,-  
 তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!  
 হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে  
 সরু- সরু- কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,  
 শিরীষের অথবা জামের  
 ঝাউয়ের-আমের,  
 কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!  
  
 জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার-  
 তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!  
 তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেচা নামে-  
 বাবলার গলির অন্ধকারে  
 অশথের জানালার ফাকে  
 কোথায় লুকায় আপনাকে!  
 চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে-  
 সোনালি সোনালি চিল- শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-  
 কুড়ি বছর পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!

৭.    তোমায় আমি
      জীবনানন্দ  দাস


তোমায় আমি দেখেছিলাম বলে  
 তুমি আমার পদ্মপাতা হলে;  
 শিশির কণার মতন শূন্যে ঘুরে  
 শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে  
 খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।  
  
 নদী সাগর কোথায় চলে ব’য়ে  
 পদ্মপাতায় জলের বিন্দু হ’য়ে  
 জানি না কিছু-দেখি না কিছু আর  
 এতদিনে মিল হয়েছে তোমার আমার  
 পদ্মপাতার বুকের ভিতর এসে।  
  
 তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই  
 শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই,  
 তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে  
 চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে  
 শরীর যেমন মনের সঙ্গে মেশে।  
  
 জানি আমি তুমি রবে-আমার হবে ক্ষয়  
 পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়।  
 এই আছে, নেই-এই আছে নেই-জীবন চঞ্চল;  
 তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল  
 বুঝেছি আমি তোমায় ভালোবেসে।

৮.     আকাশলীনা
      জীবনানন্দ  দাস


সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়োনাকো তুমি,  
 বোলোনাকো কথা ঐ যুবকের সাথে;  
 ফিরে এসো সুরঞ্জনা,  
 নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;  
  
 ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;  
 ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;  
 দূর থেকে দূরে –আরও দূরে  
 যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।  
  
 কী কথা তাহার সাথে? –তার সাথে!  
 আকাশের আড়ালে আকাশে  
 মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :  
 তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।  
  
 সুরঞ্জনা,  
 তোমার হৃদয় আজ ঘাস:  
 বাতাসের ওপারে বাতাস–  
 আকাশের ওপারে আকাশ।

৯.  যদি আমি ঝরে যাই একদিন
            জীবনানন্দ  দাস


যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়;  
 যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে,  
 যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাপাঁর নীড়ে ঠোঁট আছে গুজে,  
 যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরি পাতায়,  
 যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়,  
 শামুক গুগলিগুলো পড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে-  
 তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে,  
 ঠেস্ দিয়ে বসে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়ে,  
  
 তাহলে জানিও তুমি আসিয়াছে অন্ধকার মৃত্যুর আহ্বান-  
 যার ডাক শুনে রাঙা রৌদ্রেরো চিল আর শালিখের ভিড়  
 একদিন ছেড়ে যাবে আম জাম বনে নীল বাংলার তীর,  
 যার ডাক শুনে আজ ক্ষেতে-ক্ষেতে ঝরিতেছে খই আর মৌরির ধান;-  
 কবে যে আসিবে মৃত্যু; বাসমতী চালে-ভেজা শাদা হাতখান-  
 রাখো বুকে, হে কিশোরী, গোরোচনারূপে আমি করিব যে ম্লান।

১০.    অদ্ভুত আঁধার এক 
           জীবনানন্দ  দাস


অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,  
 যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;  
 যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই  
 পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।  
 যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি  
 এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়  
 মহত্ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা  
 শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

১১.     নীলিমা
     জীবনানন্দ  দাস


রৌদ্র ঝিল্মিল,  
 উষার আকাশ, মধ্য নিশীথের নীল,  
 অপার ঐশ্বর্যবেশে দেখা তুমি দাও বারে বারে  
 নিঃসহায় নগরীর কারাগার-প্রাচীরের পারে!  
 -উদ্বেলিছে হেথা গাঢ় ধূম্রের কুণ্ডলী,  
 উগ্র চুল্লিবহ্নি হেথা অনিবার উঠিতেছে জ্বলি,  
 আরক্ত কঙ্করগুলো মরুভূর তপ্তশ্বাস মাখা,  
 মরীচিকা-ঢাকা!  
 অগণন যাত্রিকের প্রাণ  
 খুঁজে মরে অনিবার, পায় নাকো পথের সন্ধান;  
 চরণে জড়ায়ে গেছে শাসনের কঠিন শৃঙ্খল-  
 হে নীলিমা নিষ্পলক, লক্ষ বিধিবিধানের এই কারাতল  
 তোমার ও মায়াদণ্ডে ভেঙেছ মায়াবী।  
 জনতার কোলাহলে একা ব’সে ভাবি  
 কোন্ দূর জাদুপুর-রহস্যের ইন্দ্রজাল মাখি  
 বাস্তবের রক্ততটে আসিলে একাকী!  
 স্ফটিক আলোকে তব বিথারিয়া নীলাম্বরখানা  
 মৌন স্বপ্ন-ময়ূরের ডানা!  
 চোখে মোর মুছে যায় ব্যাধবিদ্ধ ধরণীর রুধির-লিপিকা  
 জ্বলে ওঠে অন্তহারা আকাশের গৌরী দীপশিখা!  
 বসুধার অশ্রু-পাংশু আতপ্ত সৈকত,  
 ছিন্নবাস, নগ্নশির ভিক্ষুদল, নিষ্করুণ এই রাজপথ,  
 লক্ষ কোটি মুমূর্ষুর এই কারাগার,  
 এই ধূলি-ধূম্রগর্ভ বিস্তৃত আঁধার  
 ডুবে যায় নীলিমায়-স্বপ্নায়ত মুগ্ধ আঁখিপাতে,  
 -শঙ্খশুভ্র মেঘপুঞ্জে , শুক্লাকাশে, নক্ষত্রের রাতে;  
 ভেঙে যায় কীটপ্রায় ধরণীর বিশীর্ণ নির্মোক,  
 তোমার চকিত স্পর্শে, হে অতন্দ্র দূর কল্পলোক।

১২.   অন্ধকার
    জীবনানন্দ  দাস

গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;  
 তাকিয়ে দেখলাম পান্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া  
 গুটিয়ে নিয়েছে যেন  
 কীর্তিনাশার দিকে।  
 ধারসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম পউষের রাতে-  
 কোনোদিন আর জাগব না জেনে  
 কোনোদিন জাগব না আমি কোনোদিন জাগব না আর-  
 হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ  
 তুমি দিনের আলো নও, স্বপ্ন নও,  
 হৃদয়ে যে মৃত্যুর শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে,  
 রয়েছে যে অগাধ ঘুম  
 সে-আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতাতোমার নেই,  
 তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও-  
 জানো না কি চাঁদ  
 জানো না কি নিশীথে,  
 আমি অনেক দিন-  
 অনেক অনেক দিন  
 অন্ধকারের সারাৎসারে অন্তত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে  
 হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে  
 বুঝতে পেরেছি আবার;  
 ভয় পেয়েছি,  
 পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা;  
 দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে  
 মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখিদাঁড়াবার জন্য  
 আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;  
 আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায় বেদনায় আক্রোশে ভরে গিয়েছে;  
 সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে  
 উৎসব শুরু করেছে।  
 হায়, উৎসব!  
 হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকেডুবিয়ে ফেলে  
 আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি,  
 অন্ধকারের স্তনের যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে  
 থাকতে চেয়েছি।  
 কোনোদিন মানুষ ছিলাম না আমি।  
 হে নর, হে নারী।  
 তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনোদিন;  
 আমি অন্য কোনো নক্ষত্রের জীব নই।  
 যেখানে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ  
 সেখানেই সূর্য, পৃথিবীর, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি,  
 শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে,  
 শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর;  
 এই সব ভয়াবহ আরতি!  
 গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;  
 আমাকে কেন জাগাতে চাও?  
 হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া  
 আমাকে জাগাতে চাও কেন।  
 অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর;  
 তাকিয়ে দেখব না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে  
 অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে  
 কীর্তিনাশার দিকে।  
 ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব-ধীরে-পউষের রাতে।  
 কোনদিন জাগব না জেনে-  
 কোনোদিন জাগব না আমি-কোনোদিন আর।

১৩.    অবশেষে
        জীবনানন্দ  দাস


এখানে প্রশান্ত মনে খেলা করে উঁচু উঁচু গাছ।  
 সবুজ পাতার পরে যখন নেমেছে এসে দুপুরের সূর্যের আঁচ  
 নদীতে স্মরণ করে একবার পৃথিবীর সকাল বেলাকে।  
 আবার বিকেল হলে অতিকায় হরিণের মতো শান্ত থাকে।  
 এই সব গাছুগুলো, যেন কোন দূর থেকে অস্পষ্ট বাতাস  
 বাঘের ঘ্রাণের মতো হৃদয়ে জাগায়ে যায় ত্রাস;  
 চেয়ে দেখ ইহাদের পরস্পর নীলিম বিন্যাস  
 নড়ে উঠে ত্রস্ততায় আধো নীল আকাশের বুকে  
 হরিণের মতো দ্রুত ঠ্যাঙের তুরুকে  
 অন্তর্হিত হয়ে যেতে পারে তারা বটে:  
 একজোটে কাজ করে মানুষেরা যে রকম ভোটেরব্যালটে;  
 তবুও বাঘিনী হয়ে বাতাসকে আলিঙ্গন করে–  
 সাগরের বালি আর রাত্রির নক্ষত্রের তরে।
        
১৪.       নাবিক 
      জীবনানন্দ  দাস


কবে তব হৃদয়ের নদী  
 বরি নিল অসম্বৃত সুনীল জলধি!  
 সাগর-শকুন্ত-সম উল্লাসের রবে  
 দূর সিন্ধু-ঝটিকার নভে  
 বাজিয়া উঠিল তব দুরন্ত যৌবন!  
 পৃথ্বীর বেলায় বসি কেঁদে মরে আমাদের শৃঙ্খলিত মন!  
 কারাগার-মর্মরের তলে  
 নিরাশ্রয় বন্দিদের খেদ-কোলাহলে  
 ভ'রে যায় বসুধার আহত আকাশ!  
 অবনত শিরে মোরা ফিরিতেছি ঘৃণ্য বিধিবিধানের দাস!  
 -সহস্রের অঙুলিতর্জন  
 নিত্য সহিতেছি মোরা-বারিধির বিপ্লব-গর্জন  
 বরিয়া লয়েছ তুমি, তারে তুমি বাসিয়াছ ভালো;  
 তোমার পক্ষরতলে টগ্বগ্ করে খুন-দুরন্ত, ঝাঁঝালো!-  
 তাই তুমি পদাঘাতে ভেঙে গেলে অচেতন বসুধার দ্বার,  
 অবগুণ্ঠিতার  
 হিমকৃষ্ণ অঙুলির কঙ্কাল-পরশ  
 পরিহরি গেলে তুমি-মৃত্তিকার মদ্যহীন রস  
 তুহিন নির্বিষ নিঃস্ব পানপাত্রখানা  
 চকিতে চূর্ণিয়া গেলে-সীমাহারা আকাশের নীল শামিয়ানা  
 বাড়ব-আরক্ত স্ফীত বারিধির তট,  
 তরঙ্গের তুঙ্গ গিরি, দুর্গম সঙ্কট  
 তোমারে ডাকিয়া নিল মায়াবীর রাঙা মুখ তুলি!  
 নিমেষে ফেলিয়া গেলে ধরণীর শূন্য ভিক্ষাঝুলি!  
 প্রিয়ার পাণ্ডুর আঁখি অশ্রু-কুহেলিকা-মাখা গেলে তুমি ভুলি!  
 ভুলে গেলে ভীরু হৃদয়ের ভিক্ষা, আতুরের লজ্জা অবসাদ,-  
 অগাধের সাধ  
 তোমারে সাজায়ে দেছে ঘরছাড়া ক্ষ্যাপা সিন্দবাদ!  
 মণিময় তোরণের তীরে  
 মৃত্তিকায় প্রমোদ-মন্দিরে  
 নৃত্য-গীত-হাসি-অশ্রু-উৎসবের ফাঁদে  
 হে দুরন্ত দুর্নিবার-প্রাণ তব কাঁদে!  
 ছেড়ে গেলে মর্মন্তুদ মর্মর বেষ্টন,  
 সমুদ্রের যৌবন-গর্জন  
 তোমারে ক্ষ্যাপায়ে দেছে, ওহে বীর শের!  
 টাইফুন্-ডঙ্কার হর্ষে ভুলে গেছ অতীত-আখের  
 হে জলধি পাখি!  
 পে তব নাচিতেছে ল্যহারা দামিনী-বৈশাখী!  
 ললাটে জ্বলিছে তব উদয়াস্ত আকাশের রতœচূড় ময়ূখের টিপ,  
 কোন্ দূর দারুচিনি লবঙ্গের সুবাসিত দ্বীপ  
 করিতেছে বিভ্রান্ত তোমারে!  
 বিচিত্র বিহঙ্গ কোন্ মণিময় তোরণের দ্বারে  
 সহর্ষ নয়ন মেলি হেরিয়াছ কবে!  
 কোথা দূরে মায়াবনে পরীদল মেতেছে উৎসবে-  
 স্তম্ভিত নয়নে  
 নীল বাতায়নে  
 তাকায়েছ তুমি!  
 অতি দূর আকাশের সন্ধ্যারাগ-প্রতিবিম্বে প্রস্ফুটিত সমুদ্রের  
 আচম্বিত ইন্দ্রজাল চুমি  
 সাজিয়াছ বিচিত্র মায়াবী!  
 সৃজনের জাদুঘর-রহস্যের চাবি  
 আনিয়াছ কবে উন্মোচিয়া  
 হে জল-বেদিয়া!  
 অল্য বন্দর পানে ছুটিতেছ তুমি নিশিদিন  
 সিন্ধু বেদুঈন!  
 নাহি গৃহ, নাহি পান্থশালা-  
 লক্ষ লক্ষ ঊর্মি-নাগবালা  
 তোমারে নিতেছে ডেকে রহস্যপাতালে-  
 বারুণী যেথায় তার মণিদীপ জ্বালে!  
 প্রবাল-পালঙ্ক-পাশে মীননারী ঢুলায় চামর!  
 সেই দুরাশার মোহে ভুলে গেছ পিছুডাকা স্বর  
 ভুলেছ নোঙর!  
 কোন্ দূর কুহকের কূল  
 লক্ষ্য করি ছুটিতেছে নাবিকের হৃদয়-মাস্তুল  
 কে বা তাহা জানে!  
 অচিন আকাশ তারে কোন্ কথা কয় কানে কানে!

১৫.  আমি কবি-সেই কবি
          জীবনানন্দ  দাস


আমি কবি-সেই কবি-  
 আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!  
 আন্মনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙুল-মেঘের পানে!  
 মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে!  
 বুকের বাদল উথলি উঠিছে কোন্ কাজরীর গানে!  
 দাদুরী-কাঁদানো শাঙন-দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!  
  
 স্বপন-সুরার ঘোরে  
 আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দিওয়ানা ক'রে!  
 জন্ম ভরিয়া সে কোন্ হেঁয়ালি হল না আমার সাধা-  
 পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায়, পথে পথে ধায় ধাঁধা!  
 -নিমেষে পাসরি এই বসুধার নিয়তি-মানার বাধা  
 সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভ'রে!  
  
 ভুঁয়ের চাঁপাটি চুমি  
 শিশুর মতন, শিরীষের বুকে নীরবে পড়ি গো নুমি!  
 ঝাউয়ের কাননে মিঠা মাঠে মাঠে মটর-ক্ষেতের শেষে  
 তোতার মতন চকিতে কখন আমি আসিয়াছি ভেসে!  
 -ভাটিয়াল সুর সাঁঝের আঁধারে দরিয়ার পারে মেশে,-  
 বালুর ফরাশে ঢালু নদীটির জলে ধোঁয়া ওঠে ধূমি!  
  
 বিজন তারার সাঁঝে  
 আমার প্রিয়ের গজল-গানের রেওয়াজ বুঝি বা বাজে!  
 প'ড়ে আছে হেথা ছিন্ন নীবার, পাখির নষ্ট নীড়!  
 হেথায় বেদনা মা-হারা শিশুর, শুধু বিধবার ভিড়!  
 কোন্ যেন এক সুদূর আকাশ গোধূলিলোকের তীর  
 কাজের বেলায় ডাকিছে আমারে, ডাকে অকাজের মাঝে!


 জীবনানন্দ  দাসের কিছু কবিতা দেওয়া হয়েছে।আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। কবিতা গুলো  ভালো লাগলে কমেন্ট করবেন।। অবশ্যই

No comments

Theme images by diane555. Powered by Blogger.