সুকান্ত ভট্টচার্য কবিতা-সমূহ - TECHNICAL BANGLA

সুকান্ত ভট্টচার্য কবিতা-সমূহ

আসসালামু আলাইকুম, বন্ধুরা সবাই কেমন আছেন,,,?? Technical Bangla পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।

হ্যালো বন্ধুরা কবিতা পর্ব-১২: এ আপনাদের সবাইকে স্বাগতম।আমি আজকে নিয়ে আসলাম কবি  সুকান্ত ভট্টচার্য এর লেখা ১৫ টি কবিতা গুলো সবাই মনযোগ দিয়ে পড়বেন।
চলুন দেখে আসি কবিতা গুলো-

১.       হে মহাজীবন
          সুকান্ত ভট্টচার্য

হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
 এবার কঠিন কঠোর গদ্যে আনো,
 পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক
 গদ্যের করা হাতুড়িকে আজ হানো।
 প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা-
 কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
 ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়ঃ
 পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।।

২.        পুরনো ধাঁধাঁ 
           সুকান্ত ভট্টচার্য

বলতে পারো বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে?

গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?

বড়মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি-মিষ্টি,

গরীবরা পায় খোলামকুচি, একি অনাসৃষ্টি?

বলতে পারো ধনীর বাড়ি তৈরি যারা করছে,

কুঁড়েঘরেই তারা কেন মাছির মতো মরছে?

ধনীর মেয়ের দামী পুতুল হরেকরকম খেলনা,

গরীব মেয়ে পায়না আদর, সবার কাছে ফ্যালনা।

বলতে পারো ধনীর মুখে যারা যোগায় খাদ্য,

ধনীর পায়ের তলায় কেন থাকতে তারা বাধ্য?

‘হিং-টিং-ছট’ প্রশ্ন এসব, মাথায় মধ্যে কামড়ায়,

বড়লোকের ঢাক তৈরি গরীব লোকের চামড়ায়।

৩.         ছাড়পত্র
          সুকান্ত ভট্টচার্য

যে শিশু ভূমিষ্ট হল আজ রাত্রে
 তার মুখে খবর পেলুমঃ
 সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
 নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
 জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।
 খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
 উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
 কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
 সে ভাষা বুঝে না কেউ,
 কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
 আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
 পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের-
 পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ট শিশুর
 অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
 এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
 জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
 চলে যেতে হবে আমাদের।
 চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
 প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
 এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-
 নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
 অবশেষে সব কাজ সেরে,
 আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
 করে যাব আশীর্বাদ,

 তারপর হব ইতিহাস।।

৪.           দুর্মর
         সুকান্ত ভট্টচার্য

হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ
 কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,
 সে কোলাহলে রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ
 জলে ও মাটিতে ভাঙনের বেগ আসে।

 হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন
 জন্ম নিয়েছে সচেতনতার দান,
 গত আকালের মৃত্যুকে মুছে
 আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।

 “হয় দান নয় প্রাণ” এ শব্দে
 সারা দেশ দিশাহারা,
 একবার মরে ভুলে গেছে আজ
 মৃত্যুর ভয় তারা।

 সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
 অবাক তাকিয়ে রয়ঃ
 জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার
 তবু মাথা নোয়াবার নয়।

 এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে
 সোনালী নয়কো, রক্তে রঙিন দান,
 দেখবে সকলে সেখানে জ্বলছে
 দাউ দাউ করে বাংলাদেশের প্রাণ।।

৫.      আঠারো বছর বয়স 
             সুকান্ত ভট্টচার্য


আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ 
 র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি, 
 আঠারো বছর বয়সেই অহরহ 
 বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি। 

 আঠারো বছর বয়সের নেই ভয় 
 পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা, 
 এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়– 
 আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা। 

 এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য 
 বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে, 
 প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য 
 সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে। 

 আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর 
 তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা, 
 এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর 
 এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা। 

 আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার 
 পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান, 
 দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার 
 ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ। 

 আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে 
 অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো, 
 এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে 
 এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো। 

 তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি, 
 এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে, 
 বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী 
 এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে। 

 এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয় 
 পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে, 
 এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়– 
 এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।।

৬.         অদ্বৈধ
           সুকান্ত ভট্টচার্য


নরম ঘুমের ঘোর ভাঙল? 
 দেখ চেয়ে অরাজক রাজ্য; 
 ধ্বংস সমুখে কাঁপে নিত্য 
 এখনো বিপদ অগ্রাহ্য? 
 পৃথিবী, এ পুরাতন পৃথিবী 
 দেখ আজ অবশেষে নিঃস্ব 
 স্বপ্ন-অলস যত ছায়ারা 
 একে একে সকলি অদৃশ্য। 

 রুক্ষ মরুর দুঃস্বপ্ন 
 হৃদয় আজকে শ্বাসরুদ্ধ, 
 একলা গহন পথে চলতে 
 জীবন সহসা বিক্ষুব্ধ। 

 জীবন ললিত নয় আজকে 
 ঘুচেছে সকল নিরাপত্তা, 
 বিফল স্রোতের পিছুটানকে 
 শরণ করেছে ভীরু সত্তা। 

 তবু আজ রক্তের নিদ্রা, 
 তবু ভীরু স্বপ্নের সখ্য; 
 সহসা চমক লাগে চিত্তে 
 দুর্জয় হল প্রতিপক্ষ! 

 নিরুপায় ছিঁড়ে গেল দ্বৈদ 
 নির্জনে মুখ তোলে অঙ্কুর, 
 বুঝে নিল উদ্যোগী আত্মা 
 জীবন আজকে ক্ষণভঙ্গুর। 

 দলিত হৃদয় দেখে স্বপ্ন 
 নতুন, নতুনতর বিশ্ব, 
 তাই আজ স্বপ্নের ছায়ারা 
 একে একে সকলি অদৃশ্য।।

৭.      অনুভবন
       সুকান্ত ভট্টচার্য


১৯৪০ 
 অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি 
 জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। 
 অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন। 
 অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন; 
 অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো- 
 দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো। 
 অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার 
 দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার। 
 হিসেবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে 
 দেখেছি লিখিত- 'রক্ত খরচ' তাতে। 
 এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম, 
 অবাক পৃথিবী! সেলাম, তোমাকে সেলাম! 

 ১৯৪৬ 
 বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে, 
 আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে, 
 এত বিদ্রোহ কখনো দেখে নি কেউ, 
 দিকে দিকে ওঠে অবাদ্যতার ঢেউ; 
 স্বপ্ন-চূড়ার থেকে নেমে এসো সব 
 শুনেছ? শুনছ উদ্দাম কলরব? 
 নয়া ইতিহাস লিখছে ধর্মঘট; 
 রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট। 
 প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত, 
 দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত; 
 তাদেরই দলের পেছনে আমিও আছি, 
 তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি-বাঁচি। 
 তাইতো চলেছি দিন-পঞ্জিকা লিখে 
 বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে।।

৮.     অভিবাদন
       সুকান্ত ভট্টচার্য


হে সাথী, আজকে স্বপ্নের দিন গোনা 
 ব্যর্থ নয় তো, বিপুল সম্ভাবনা 
 দিকে দিকে উদ্যাপন করছে লগ্ন, 
 পৃথিবী সূর্য-তপস্যাতেই মগ্ন। 

 আজকে সামনে নিরুচ্চারিত প্রশ্ন, 
 মনের কোমল মহল ঘিরে কবোষ্ণ 
 ক্রমশ পুষ্ট মিলিত উন্মাদনা, 
 ক্রমশ সফল স্বপ্নের দিন গোনা। 

 স্বপ্নের বীজ বপন করেছি সদ্য, 
 বিদ্যুৎবেগে ফসল সংঘবদ্ধ! 
 হে সাথী, ফসলে শুনেছো প্রাণের গান? 
 দুরন্ত হাওয়া ছড়ায় ঐকতান। 

 বন্ধু, আজকে দোদুল্যমান পৃথ্বী 
 আমরা গঠন করব নতুন ভিত্তি; 
 তারই সুত্রপাতকে করেছি সাধন 
 হে সাথী, আজকে রক্তিম অভিবাদন।।

৯.    অলক্ষ্যে
    সুকান্ত ভট্টচার্য

আমার মৃত্যুর পর কেটে গেল বৎসর বৎসর; 
 ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতির ব্যর্থ প্রচেষ্টাও আজ অগভীর, 
 এখন পৃথিবী নয় অতিক্রান্ত প্রায়ান্ধ স্থবির; 
 নিভেছে প্রদূম্রজ্বালা, নিরঙ্কুশ সূর্য অনশ্বর ; 
 স্তব্ধতা নেমেছে রাত্রে থেমেছে নির্ভীক তীক্ষ্ণস্বর- 
 অথবা নিরন্ন দিন, পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা ; 
 উদ্ধত বজ্রের ভয়ে নিঃশব্দে মৃত্যুর আনাগোনা, 
 অনন্য মানবসত্তা ক্রমান্বয়ে স্বল্পপরিসর। 

 গলিত স্মৃতির বাস্প সেদিনের পল্লব শাখায় 
 বারম্বার প্রতারিত অস্ফুট কুয়াশা রচনায়; 
 বিলুপ্ত বজ্রের ঢেউ নিশ্চিত মৃত্যুতে প্রতিহত। 
 আমার অজ্ঞাত দিন নগণ্য উদার উপেক্ষাতে 
 অগ্রগামী শূন্যতাকে লাঞ্চিত করেছে অবিরত 
 তথাপি তা প্রস্ফুটিত মৃত্যুর অদৃশ্য দুই হাতে।।

১০.   আমরা এসেছি
          সুকান্ত ভট্টচার্য

কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে, ভেঙেছে খিল, 
 মিছিলে আমারা নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল। 
 দুঃখ-যুগের দারায় দারায় 
 যারা আনে প্রাণ, যারা তা হারায় 
 তারাই ভরিয়ে তুলেছে সাড়ায় হৃদয়-বিল। 
 তারাই এসেছে মিছিলে, আজকে চলে মিছিল- 

 কে যেন ক্ষুব্ধ ভোমরার চাকে ছুঁড়েছে ঢিল, 
 তাইতো দগ্ধ, ভগ্ন, পুরনো পথ বাতিল। 
 আশ্বিন থেকে বৈশাখে যারা 
 হাওয়ার মতন ছুটে দিশেহারা, 
 হাতের স্পর্শে কাজ হয় সারা, কাঁপে নিখিল 
 তারা এল আজ দুর্বারগতি চলে মিছিল- 

 আজকে হালকা হাওয়ায় উড়ুক একক চিল 
 জনতরঙ্গে আমরা ক্ষিপ্ত ঢেউ ফেনিল। 
 উধাও আলোর নিচে সমারোহ , 
 মিলিত প্রাণের একী বিদ্রোহ! 
 ফিরে তাকানোর নেই ভীরু মোহ, কী গতিশীল! 
 সবাই এসেছে, তুমি আসোনিকো, ডাকে মিছিল- 
 একটি কথায় ব্যক্ত চেতনাঃ আকাশে নীল, 
 দৃষ্টি সেখানে তাইতো পদধ্বনিতে মিল। 
 সামনে মৃত্যুকবলিত দ্বার, 
 থাক অরণ্য, থাক না পাহাড়, 
 ব্যর্থ নোঙর, নদী হব পার, খুঁটি শিথিল। 
 আমরা এসেছি মিছিলে, গর্জে ওঠে মিছিল।।

১১.       উদ্বীক্ষণ
          সুকান্ত ভট্টচার্য

নগরে ও গ্রামে জমেছে ভিড় 
 ভগ্ননীড়,- 
 ক্ষুদিত জনতা আজ নিবিড়। 
 সমুদ্রে জাগে না বাড়বানল, 
 কী উচ্ছল, 
 তীরসন্ধানী ব্যাকুল জল। 
 কখনো হিংস্র নিবিড় শোকে; 
 দাঁতে ও নখে- 
 জাগে প্রতিজ্ঞা অন্ধ চোখে। 
 তবু সমুদ্র সীমানা রাখে, 
 দুর্বিপাকে 
 দিগন্তব্যাপী প্লাবন ঢাকে। 
 আসন্ন ঝড়ো অরণ্যময় 
 যে বিস্ময় 
 ছড়াবে, তার কি অযথা ক্ষয়? 
 দেশে ও বিদেশে লাগে জোয়ার, 
 ঘোড়সোয়ার 
 চিনে নেবে দৃঢ় লোহার, 
 যে পথে নিত্য সূর্যোদয় 
 আনে প্রলয়, 
 সেই সীমান্তে বাতাস বয়; 
 তাই প্রতীক্ষা- ঘনায় দিন 
 স্বপ্নহীন।।

১২.      চিরদিনের
           সুকান্ত ভট্টচার্য

এখানে বৃষ্টিমুখর লাজুক গাঁয়ে 
 এসে থেমে গেছে ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটা, 
 সবুজ মাঠেরা পথ দেয় পায়ে পায়ে 
 পথ নেই, তবু এখানে যে পথ হাঁটা। 

 জোড়া দীঘি, তার পাড়েতে তালের সারি 
 দূরে বাঁশঝাড়ে আত্মদানের সাড়া, 
 পচা জল আর মশায় অহংকারী 
 নীরব এখানে অমর কিষাণপাড়া। 

 এ গ্রামের পাশে মজা নদী বারো মাস 
 বর্ষায় আজ বিদ্রোহ বুঝি করে, 
 গোয়ালে পাঠায় ইশারা সবুজ ঘাস 
 এ গ্রাম নতুন সবুজ ঘাগরা পরে। 

 রাত্রি এখানে স্বাগত সান্ধ্য শাঁখে 
 কিষাণকে ঘরে পাঠায় যে আল-পথ; 
 বুড়ো বটতলা পরস্পরকে ডাকে 
 সন্ধ্যা সেখানে জড়ো করে জনমত। 

 দুর্ভিক্ষের আঁচল জড়ানো গায়ে 
 এ গ্রামের লোক আজো সব কাজ করে, 
 কৃষক-বধূরা ঢেঁকিকে নাচায় পায়ে 
 প্রতি সন্ধ্যায় দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে। 

 রাত্রি হলেই দাওয়ার অন্ধকারে 
 ঠাকুমা গল্প শোনায় যে নাতনীকে, 
 কেমন ক'রে সে আকালেতে গতবারে, 
 চলে গেল লোক দিশাহারা দিকে দিকে। 

 এখানে সকাল ঘোষিত পাখির গানে 
 কামার, কুমোর, তাঁতী তার কাজে জোটে, 
 সারাটা দুপুর ক্ষেতের চাষীরা কানে 
 একটানা আর বিচিত্র ধ্বনি ওঠে। 

 হঠাৎ সেদিন জল আনবার পথে 
 কৃষক-বধূ সে থমকে তাকায় পাশে, 
 ঘোমটা তুলে সে দেখে নেয় কোনোমতে, 
 সবুজ ফসলে সুবর্ণ যুগ আসে।।

১৩.  একুশে নভেম্বর:১৯৪৬
            সুকান্ত ভট্টচার্য

আবার এবার দুর্বার সেই একুশে নভেম্বর- 
 আকাশের কোণে বিদ্যুৎ হেনে তুলে দিয়ে গেল 
 মুত্যুকাঁপানো ঝড়। 
 আবার এদেশে মাঠে, ময়দানে 
 সুদূর গ্রামেও জনতার প্রাণে 
 হাসানাবাদের ইঙ্গিত হানে 
 প্রত্যাঘাতের স্বপ্ন ভয়ঙ্কর। 
 আবার এসেছে অবাধ্য এক একুশে নভেম্বর।। 
 পিছনে রয়েছে একটি বছর, একটি পুরনো সাল, 
 ধর্মঘট আর চরম আঘাতে উদ্দাম, উত্তাল; 
 বার বার জিতে, জানি অবশেষে একবার গেছি হেরে- 
 বিদেশী! তোদের যাদুদণ্ডকে এবার নেবই কেড়ে। 
 শোন্ রে বিদেশী, শোন্ 
 আবার এসেছে লড়াই জেতার চরম শুভক্ষণ। 
 আমরা সবাই অসভ্য, বুনো- 
 বৃথা রক্তের শোধ নেব দুনো 
 একপা পিছিয়ে দু'পা এগোনোর 
 আমরা করেছি পণ, 
 ঠ'কে শিখলাম- 
 তাই তুলে ধরি দুর্জয় গর্জন। 
 আহ্বান আসে অনেক দূরের, 
 হায়দ্রাবাদ আর ত্রিবাঙ্কুরের, 
 আজ প্রয়োজন একটি সুরের 
 একটি কঠোর স্বরঃ 
 দেশী কুকুর! আবার এসেছে একুশে নভেম্বর। 
 ডাক ওঠে, ডাক ওঠে- 
 আবার কঠোর বহু হরতালে 
 আসে মিল্লাত, বিপ্লবী ডালে 
 এখানে সেখানে রক্তের ফুল ফোটে। 
 এ নভেম্বরে আবারো তো ডাক ওঠে।। 

 আমাদের নেই মৃত্যু এবং আমাদের নেই ক্ষয়, 
 অনেক রক্ত বৃথাই দিলুম 
 তবু বাঁচবার শপথ নিলুম 
 কেটে গেছে আজ রক্তদানের ভয়! 
 ল'ড়ে মরি তাই আমরা অমর, আমরাই অক্ষয়।। 

 আবার এসেছে তেরোই ফেব্রুয়ারী, 
 দাঁতে দাঁত চেপে 
 হাতে হাত চেপে 
 উদ্যত সারি সারি , 
 কিছু না হলেও আবার আমরা 
 রক্ত দিতে তো পারি? 
 পতাকায় পতাকায় ফের মিল আনবে ফেব্রুয়ারি। 
 এ নভেম্বরে সংকেত পাই তারি।।

১৪.     ঐতিহাসিক
          সুকান্ত ভট্টচার্য

আজ এসেছি তোমাদের ঘরে ঘরে 
 পৃথিবীর আদালতের পরোয়ানা নিয়ে 
 তোমরা কি দেবে আমার প্রশ্নের কৈফিয়ৎঃ 
 কেন মৃত্যুকীর্ণ শবে ভরলো পঞ্চাশ সাল? 
 আজ বাহান্ন সালের সূচনায় কি তার উত্তর দেবে? 
 জানি! স্তব্ধ হয়ে গেছে তোমাদের অগ্রগতির স্রোত, 
 তাই দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়ায় কালো করছ ভবিষ্যৎ 
 আর অনুশোচনার আগুনে ছাই হচ্ছে উৎসাহের কয়লা। 
 কিন্তু ভেবে দেখেছ কি? 
 দেরি হয়ে গেছে অনেক, অনেক দেরি! 
 লাইনে দাঁড়ানো অভ্যেস কর নি কোনোদিন, 
 একটি মাত্র লক্ষ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে 
 মারামারি করেছ পরস্পর, 
 তোমাদের ঐক্যহীন বিশৃঙ্খলা দেখে 
 বন্ধ হয়ে গেছে মুক্তির দোকানের ঝাঁপ। 
 কেবল বঞ্চিত বিহ্বল বিমূঢ় জিজ্ঞাসাভরা চোখে 
 প্রত্যেকে চেয়েছ প্রত্যেকের দিকেঃ 
 -কেন এমন হল? 

 একদা দুর্ভিক্ষ এল 
 ক্ষুদার মাহীন তাড়নায় 
 পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি সবাই দাঁড়ালে একই লাইনে 
 ইতর-ভদ্র, হিন্দু আর মুসলমান 
 একই বাতাসে নিলে নিঃশ্বাস। 
 চাল, চিনি, কয়লা, কেরোসিন? 
 এ সব দুষ্প্রাপ্য জিনিসের জন্য চাই লাইন। 
 কিন্তু বুঝলে না মুক্তিও দুর্লভ আর দুর্মূল্য, 
 তারো জন্যে চাই চল্লিশ কোটির দীর্ঘ, অবিচ্ছিন্ন এক লাইন। 

 মূর্খ তোমরা 
 লাইন দিলেঃ কিন্তু মুক্তির বদলে কিনলে মৃত্যু, 
 রক্তয়ের বদলে পেলে প্রবঞ্চনা। 
 ইতিমধ্যে তোমাদের বিবদমান বিশৃঙ্খল ভিড়ে 
 মুক্তি উঁকি দিয়ে গেছে বহুবার। 
 লাইনে দাঁড়ানো আয়ত্ত করেছে যারা, 
 সোভিয়েট, পোল্যান্ড, ফ্রান্স 
 রক্তমূল্যে তারা কিনে নিয়ে গেল তাদের মুক্তি 
 সর্ব প্রথম এই পৃথিবীর দোকান থেকে। 
 এখনো এই লাইনে অনেকে প্রতীক্ষমান, 
 প্রার্থী অনেক; কিন্তু পরিমিত মুক্তি। 
 হয়তো এই বিশ্বব্যাপী লাইনের শেষে 
 এখনো তোমাদের স্থান হতে পারে- 
 এ কথা ঘোষণা ক'রে দাও তোমাদের দেশময় 
 প্রতিবেশীর কাছে। 
 তারপর নিঃশব্দে দাঁড়াও এ লাইনে প্রতিজ্ঞা 
 আর প্রতীক্ষা নিয়ে 
 হাতের মুঠোয় তৈরী রেখে প্রত্যেকের প্রাণ। 
 আমি ইতিহাস, আমার কথাটা একবার ভেবে দেখো, 
 মনে রেখো, দেরি হয়ে গেছে, অনেক অনেক দেরি। 
 আর মনে ক'রো আকাশে আছে এক ধ্রুব নক্ষত্র, 
 নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ, 
 অরণ্যের মর্মরধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা, 
 আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন।।

১৫.    কবিতার খসড়া
          সুকান্ত ভট্টচার্য

আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায় 
 কারা বিদ্রোহে পথ মাড়ায় 
 ভরে দিগন্ত দ্রুত সাড়ায়, 
 জানে না কেউ। 
 উদ্যমহীন মূঢ় কারায় 
 পুরনো বুলির মাছি তাড়ায় 
 যারা, তারা নিয়ে ঘোরে পাড়ায় 
 স্মৃতির ফেউ।।



আমাদের সাথে থাকার জন্য  অসংখ্য ধন্যবাদ।আমার লেখার ভিতর যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে তাহলে আমাকে ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন,,,,,,,প্লিজ।

No comments

Theme images by diane555. Powered by Blogger.